সু চিকে রক্ষা করে সঙ্কট সমাধানের চেষ্টামিয়ানমারের ওপর নিষেধাজ্ঞা চাচ্ছে না ইউরোপ-আমেরিকা

ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোর্ট:রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে চাপ সৃষ্টির জন্য মিয়ানমারের ওপর এখনই অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার মতো কঠোর পদক্ষেপে যেতে চাইছে না ইউরোপ ও আমেরিকা। পশ্চিমা দেশগুলোর মতে, এর ফলে মিয়ানমারের গণতন্ত্রায়ন প্রক্রিয়াই হুমকির মুখে পড়তে পারে। কোনঠাসা হয়ে পড়তে পারেন দেশটির ক্ষমতাসীন দলের নেত্রী অং সান সু চি। তাই সু চিকে রক্ষা করে বিকল্প হিসেবে কূটনৈতিক প্রচেষ্টার দিকেই জোর দিচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও যুক্তরাষ্ট্র।

এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির আজ নয়া দিগন্তের সাথে আলাপকালে বলেন, সমস্যার সমাধানের বেশ কয়েকটি পথ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বা ইইউ তাদের পথে সমস্যার সমাধান করতে পারলে আমাদের আপত্তি থাকার কোনো কারণ নেই। মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে এ সমস্যাটি সমাধানের সুযোগ অপেক্ষাকৃত বেশি।

তিনি বলেন, বাংলাদেশে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কোনো হস্তক্ষেপ করছে না। আমরা চাচ্ছি কফি আনান কমিশনের রিপোর্টের আলোকে রোহিঙ্গা সমস্যার টেকসই সমাধান, যাতে এই সঙ্কটের পুনরাবৃত্তি না হয়। পশ্চিমা দেশগুলোও রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও মর্যাদার সাথে প্রত্যাবাসন চায়। এদিক থেকে পশ্চিমাদের অবস্থানের সাথে বাংলাদেশের প্রত্যাশার মিল রয়েছে।

অংশীদারিত্ব সংলাপে নেতৃত্ব দিতে ঢাকায় আসা মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের আন্ডার সেক্রেটারি থমাস শ্যানন বলেছেন, মিয়ানমারের ওপর বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপের সুযোগ যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে। কিন্তু এ মুহূর্তে আমাদের লক্ষ্য সঙ্কটের সমাধান করা, কাউকে শাস্তি দেয়া নয়। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র কূটনৈতিক প্রচেষ্টাকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছে। এ লক্ষ্যে আমরা বাংলাদেশ সরকার ও জাতিসঙ্ঘসহ আন্তর্জাতিক ফোরামে কাজ করে যেতে চাই।

অন্যদিকে রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে আলোচনা করতে মিয়ানমার হয়ে বাংলাদেশে আসা উচ্চ পর্যায়ের মার্কিন প্রতিনিধি দলের নেতা যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যা, শরণার্থী ও অভিবাসন ব্যুরোর ভারপ্রাপ্ত সহকারী মন্ত্রী সাইমন হেনশ বলেছেন, আমরা চাপ সৃষ্টি নয়, বরং সমাধানের দিকে দ্রুত অগ্রসর হওয়ার জন্য মিয়ানমারকে উৎসাহ দেব। রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছা ও নিরাপদ প্রত্যাবাসনে আমরা কূটনৈতিক ও অন্যান্য পন্থা অবলম্বনে বিশ্বাসী। বাংলাদেশের সাথে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার প্রক্রিয়া যতই হতাশাজনক হোক না কেন, তা অব্যাহত রাখতে হবে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আলোচনার মাধ্যমে সঙ্কটের দ্রুত সমাধানের লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র প্রয়োজনীয় ভূমিকা রাখবে।

ওয়াশিংটন দূতাবাসে কর্মরত বাংলাদেশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নয়া দিগন্তকে জানান, যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের উভয় কক্ষে মিয়ানমারের সামরিক নেতৃত্বের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের একটি বিল উত্থাপিত হয়েছে। এটি পাস হলে প্রেসিডেন্টের সইয়ের পর তা আইনে পরিণত হবে। তবে বিলে সই করা বা না করার ব্যাপারে প্রেসিডেন্টে স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা রাখে। এছাড়া সু চি নির্বাচিত হওয়ার পর মিয়ানমারের ওপর বহুদিন ধরে আরোপিত বেশ কিছু নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র সরকার। এখন প্রয়োজন মনে করলে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর তা আবারো পুনর্বহাল করতে পারে।

তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা গত বছর মিয়ানমারকে বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে জিএসপি সুবিধা দিয়েছিলেন। চলতি বছর তা পুন:মূল্যায়ন করা হবে।

তবে রোহিঙ্গা ইস্যুতে সবচেয়ে পরিষ্কার বক্তব্য এসেছে ইইউ’র নবনিযুক্ত রাষ্ট্রদূত রেঞ্জে তেয়ারিঙ্কের কাছ থেকে। চীন ও রাশিয়ার ভূমিকার কারণে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টিতে সীমাবদ্ধতা রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, দেশ দু’টির ভূমিকা জাতিসঙ্ঘ নিরাপদে আমাদের কাছে দৃশ্যমান হয়েছে। এ জন্য আমরা রাখাইন সঙ্কট নিরসনে নিরাপত্তা পরিষদে অনেক প্রস্তাবই পাস করতে পারিনি। এর সাথে বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ জড়িত। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যেগে মিয়ানমার গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। এসব কারণে মিয়ানমারে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন ও জাতিগত নির্মূল অভিযান চলার পরও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সমন্বিতভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে দ্বিধাগ্রস্থ।

লুক্সেমবার্গে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ইইউ পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানসহ সামরিক বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ইউরোপে আমন্ত্রণ না জানানো এবং দেশটির ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখার যে সিদ্ধান্ত হয়েছে তাকে প্রাথমিক ও প্রতিকী পদক্ষেপ হিসেবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের সাথে দ্বিপক্ষীয় সমঝোতার মাধ্যমে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে মিয়ানমারের প্রতিশ্রুতির অভাব আমাদের চোখে পরছে। রাখাইন সঙ্কট নিরসনে আমরা কফি আনান কমিশন প্রতিবেদনের বাস্তবায়ন চেয়েছি। যদি এসব ক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতি না হয়, তবে ইইউ মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগে আরো পদক্ষেপ নেবে। আর অর্থনৈতিক অবরোধ হচ্ছে কোনো দেশের ওপর চাপ প্রয়োগের সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র। তার আগে আমাদের হাতে থাকা অন্যান্য অস্ত্রগুলোর কার্যকারীতা যাচাই করে দেখতে চাই। কেননা মিয়ানমারকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উত্তরনের জন্য আমাদের অনেক বিনিয়োগ করতে হয়েছে। আগামী ২০ ও ২১ নভেম্বর মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোতে অনুষ্ঠেয় আসেম সম্মেলনে রাখাইন সঙ্কট নিরসনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে ইইউ ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতা চালানোর পরিকল্পনা করেছে।

জাতিসঙ্ঘের আবাসিক সমন্বয়ক রবার্ট ওয়াটকিন্স বলেছেন, সদস্য রাষ্ট্রগুলোর ম্যান্ডেট ছাড়া শান্তিরক্ষী বাহিনী বা অন্য কোনো পন্থায় মিয়ানমারে হস্তক্ষেপ করার অধিকার জাতিসঙ্ঘের নেই। এজন্য নিরাপত্তা পরিষদে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব পাস হতে হবে।

হুমায়ুন কবির বলেন, দ্বিপক্ষীয়ভাবে এ সমস্যার সমাধান যে সম্ভব নয়, ১৯৯২ সাল থেকে ৩২ হাজার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুটি ঝুলে থাকা এর জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। জাতিগত নিধনের ঘটনা ঘটলে ইস্যুটি দুই দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। তখন এটি আন্তর্জাতিক ইস্যুতে পরিণত হয়। এ কারণেই রোহিঙ্গা ইস্যুটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চলে গেছে। আর দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমস্যার সমাধানে মিয়ানমারের দিক থেকেও সদিচ্ছার কোনো ইঙ্গিত আমরা পায়নি।

তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বা ইইউ কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে সমস্যার সমাধান করতে পারলে বাংলাদেশকে জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবের দিকেও তাকিয়ে থাকতে হবে না। প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে মিয়ানমারের কাছ থেকে নীতিগত সম্মতি আদায়টা গুরুত্বপূর্ণ।

মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর প্রভাব উপেক্ষা করে সু চি কতটা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া ক্ষমতা রাখেন- জানতে চাওয়া হলে সাবেক এই রাষ্ট্রদূত বলেন, সু চিকে ক্ষমতায় থাকতে হলে সামরিক বাহিনীর সাথে সমঝোতা করে চলতে হবে। আর পুনর্নিবাচিত হতে হলে মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ভোট তার প্রয়োজন হবে। তাই বিভিন্ন দিক থেকে সু চিকে ভারসাম্য বজায় রাখতে হচ্ছে।

Check Also

বিএনপি নেতাকর্মীদের জড়িয়ে হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে দেবহাটায় মানববন্ধন

দেবহাটা প্রতিনিধি: স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার দোসর এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও ভূমিদস্যুদের গ্রেফতার এবং বিএনপির …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।