বাংলাদেশেসহ সারাবিশ্বে ব্যাংকগুলোর ইসলামী ব্যাংকিংয়ে আগ্রহ বাড়ছে

ইসলামী ব্যাংকিং বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে ক্রমবিকাশমান ও ব্যাপক জনপ্রিয় একটি ব্যাংকিং ব্যবস্থা। ইসলামী ব্যাংকিং বলতে সহজে যে কথা বোঝা যায় সেটি হলো, ইসলাম নির্দেশিত পন্থায় ব্যাংক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা।

মালয়েশিয়ার ইসলামী ব্যাংকিং অ্যাক্টে ইসলামী ব্যাংকের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘ইসলামী ব্যাংকিং এমন একধরনের ব্যবসা, যার লক্ষ্য ও কর্মকাণ্ডের কোথাও এমন কোনো উপাদান নেই, যা ইসলাম অনুমোদন করে না।’ ইসলামী সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি) ইসলামী ব্যাংকের একটি সংজ্ঞা দিয়েছে। সেটি হলো, Islami Bank is a financial institution whose statutes, rules and procedures expressly state its commitment to the principles of Islamic Sharia and to the banning of the receipt and payment of interest on any of its operations.

অর্থাৎ ইসলামী ব্যাংক এমন একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যা তার মৌলিক বিধান ও কর্মপদ্ধতির সব স্তরে ইসলামী শরিয়তের নীতিমালা মেনে চলতে বদ্ধপরিকর এবং কর্মকাণ্ডের সব পর‌্যায়ে সুদ বর্জন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা ইসলামী অর্থনীতি বাস্তবায়নে নিয়োজিত একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এসব ব্যাংক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় ইসলামী শরিয়তের বিধি-বিধান মেনে চলার প্রতিশ্রুতি দেয়। যদিও এ ক্ষেত্রে নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তথাপি ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলো ব্যাংক ব্যবস্থার ইসলামীকরণের পথে দিন দিন উন্নতি করছে। এবং শরিয়া অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্যবৃন্দ লেনদেনগুলোর স্বচ্ছতা, ইসলামের অনুসরণ ও বিকল্প পদ্ধতি আবিষ্কারে প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

এ লক্ষ্য অর্জনে ইসলামী ব্যাংক আল-ওয়াদিয়াহ ও মুদারাবা পদ্ধতিতে মানুষের কাছ থেকে টাকা জমা নেয়। এ ছাড়া আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে শরিয়া অনুমোদিত ব্যবসায় ব্যাংক তার অর্থ বিনিয়োগ করে।

বিভিন্ন ব্যবসার সঙ্গে ইসলামী ব্যাংকগুলো জড়িত। এসব প্রতিষ্ঠান শিল্প-বাণিজ্য ও অন্য ব্যবসায় অর্থ বিনিয়োগ করে এবং লাভ-লোকসানে অংশগ্রহণ করে। এটি শুধু লাভই হিসাব করে না, লোকসানের ঝুঁকিও বহন করে।

সুদ সম্পূর্ণরূপে পরিহার করে চলা ইসলামী ব্যাংকগুলোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ইসলাম ক্রয়-বিক্রয়কে হালাল এবং সুদকে হারাম করেছে—এর আলোকে ইসলামী ব্যাংকগুলো কর্মপন্থা স্থির করে। এ জন্য ব্যাংকগুলোর রয়েছে অনেকগুলো বেচাকেনা পদ্ধতি। বাই-মুয়াজ্জাল, বাই-মুরাবাহা, বাই-সালাম, বাই-ইসতিসনা ও বাই আস-সর্ফ প্রভৃতি পদ্ধতিতে ইসলামী ব্যাংকগুলো গ্রাহকের সঙ্গে বেচাকেনায় অংশ নেয়। ব্যাংক অর্থের বিনিময়ে দ্রব্যসামগ্রী ও সেবা ক্রয় করে এবং তা অর্থের বিনিময়ে বিক্রি করে। এ ক্রয়-বিক্রয় থেকে যে উদ্বৃত্ত তা ব্যাংকের মুনাফা হিসেবে আসে।

ব্যাংক ব্যবস্থার ইসলামীকরণে এই ধারা খুব পুরনো নয়। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের পরিধি বাড়ছে। ইসলামিক উইন্ডো চালু করতে শুরু করেছে নানা নামিদামি আন্তর্জাতিক ব্যাংকও। ইসলামী ব্যাংকিংয়ের এই অগ্রযাত্রার কথা অকপটে স্বীকার করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)।

১৯৫০-এর শেষ দিকে পল্লী এলাকায় একটি স্থানীয় ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পাকিস্তানে প্রথম ইসলামী ব্যাংক গড়ে তোলার প্রচেষ্টা শুরু হয়। মিসরের নীল নদের ব-দ্বীপে একটি পল্লী এলাকায় ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৭ সালের মধ্যে মিত গমার সেভিংস ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের দ্বিতীয় নিরীক্ষা পরিচালনা করা হয়। মিসরের উদাহরণ অনুসরণ করে মালয়েশিয়ায় ১৯৬৩ সালে এবং দুবাইতে ১৯৭৫ সালে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের আবির্ভাব ঘটে।

১৯৭৫ সালে মুসলিম দেশগুলো একটি বহুজাতিক উন্নয়ন করপোরেশন হিসেবে ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে। বাংলাদেশ ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের এক সদস্য হয়।

১৯৮৩ সালে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড (আইবিবিএল) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের যাত্রা শুরু হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, দেশে ১০টি ব্যাংক ‘পূর্ণাঙ্গরূপে শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকিং’ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এগুলো হলো—ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, এক্সপোর্ট ইমপোর্ট ব্যাংক (এক্সিম) লিমিটেড, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড, শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড, ইউনিয়ন ব্যাংক ও আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক লিমিটেড। এর পাশাপাশি এ বছরের ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে পুরোপুরি ইসলামী ধারার ব্যাংক হওয়ার অনুমতি পেয়েছে এনআরবি গ্লোবাল ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক।

এসব ব্যাংকের পাশাপাশি ইসলামী ব্যাংকিং শাখা খুলেছে আরো বেশ কিছু ব্যাংক। সেগুলো হলো—

সোনালী ব্যাংক লিমিটেড, অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড, পূবালী ব্যাংক লিমিটেড, এবি ব্যাংক লিমিটেড, সিটি ব্যাংক লিমিটেড, প্রাইম ব্যাংক লিমিটেড, সাউথইস্ট ব্যাংক লিমিটেড, ঢাকা ব্যাংক লিমিটেড, প্রিমিয়ার ব্যাংক লিমিটেড, ব্যাংক এশিয়া লিমিটেড, ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেড ও যমুনা ব্যাংক লিমিটেড। সর্বশেষ এগুলোর সঙ্গে যুক্ত হলো মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেড।

দেশের পুরো ব্যাংক খাতের আমানত ও বিনিয়োগ উভয় দিক থেকেই এক-চতুর্থাংশ শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকগুলোর দখলে।

করোনাভাইরাসের কারণে যখন অন্য ব্যাংকগুলোর আমানতে টান পড়েছে, ঠিক তখনই এক লাখ কোটি টাকার বিশাল মাইলফলক অতিক্রম করেছে বেসরকারি খাতের ইসলামী ব্যাংক; যা বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের ব্যাংকের জন্য নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। দেশের ব্যাংক খাতের আমানতের ৮.৬৪ শতাংশ এখন ইসলামী ব্যাংকের। এসব তথ্য অন্য ব্যাংকগুলোর মনোযোগ আকর্ষণ করছে।

আর ইসলামী ব্যাংকগুলোর আধিপত্য যে দিন দিন বাড়ছে, তা বলাই বাহুল্য।

kasemsharifcu@gmail.com

Please follow and like us:

Check Also

আগামী বছর এসএসসি পরীক্ষা হবে ৫ ঘণ্টার

২০২৫ সালে নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমান পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।