আলমগীর কবিরঃ বাংলাদেশে মুসলিম স্থাপত্যের যেসব অনন্য নির্দশন আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে তার মধ্যে অন্যতম দেশের সর্ব দক্ষিণ- পশ্চিম অঞ্চলে অবস্থিত সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার মথুরেশপুর ইউনিয়নে অবস্থিত প্রবাজপুর শাহী মসজিদ। মসজিদটি মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে ১৬৯৩ খিস্টাব্দে তৎকালীন ধুলিয়াপুর পরগনায় নির্মিত হয় বলে অনুমান করা হয়।
এটি একটি মুসলিম কীর্তি অতীত ঐতিহ্য এবং ঐতিহাসিক নিদর্শন। এই মসজিদসম্পর্কে একটি প্রচলিত কিংবদন্তি হচ্ছে জিনেরা জঙ্গল কেঁটে পরিস্কার করে রাতারাতি নাকি মসজিদটি তৈরী করেছিল। আরো জনশ্রুতি আছে যে, এই মসজিদে এসে কেউ কোন মানত করলে তা নাকি বিফলে যায় না।
তবে এ মসজিদ সম্পর্কে প্রত্নতত্ত্ববিদদের আরও একটি ধারণা প্রচলিত আছে। সেটি হচ্ছে- দিল্লী সুলতানদের সোনালী যুগে সাতক্ষীরায় মুসলমানদের আগমণ শুরু হয়। তখন থেকে ইসলামের সুমহান বারতা নিয়ে আসতে থাকেন পীর-দরবেশ, সুফী, সাধকরা। আসেন খানজাহান আলী, শাহ সুলতান, বোগদাদী প্রমুখ। তারা এ অঞ্চলের নানা জায়গায় নবদিক্ষীত মুসলমানদের নামাজ পড়ার জন্য মসজিদ নির্মাণ করেন। প্রাবজপুর শাহী মসজিদ সেসব মসজিদের একটি হতে পারে।
প্রত্নতত্ত্ব বিশারদদের মতে, ১১০৪ হিজরিতে ২৪ মে ১৬৯৩ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট আওরঙ্গজেব এই এলাকায় তার রক্ষিত মুসলমান সৈন্যদের পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার জন্য সুবেদার পরবাজ খাঁকে একটি মসজিদ নির্মাণ করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। এই নির্দেশ পাওয়ার পর তিনি এই এলাকায় একটি এক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ নির্মাণ করেন। যে গ্রামটিতে তার সৈন্যরা থাকত সেই গ্রামটির নাম করণ তার নাম অনুসারে করা হয়েছিল প্রবাজপুর গ্রাম। পরবর্তীতে মসজিদ নির্মাণ করার পর মসজিদটির নাম করণ করা হয় তার নাম অনুসারে প্রবাজ শাহী মসজিদ।
পরবর্তীতে মসজিদটি প্রত্বতত্ত্ব বিভাগের দৃষ্টি আনা হলে এই বিভাগ ঐতিহাসিক মসজিদটির সংস্কার কাজে হাত দেয়।
সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময় তার ফৌজদার নবাব নুরুল্লাহ খাঁ এ মসজিদের নামে লাখেরাজে ৫০ বিঘা জমি দান করেন।
একটি ফার্সি পরওয়ানা থেকে জানা যায়, মসজিদটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ৫০ একর জমি দান করা হয়েছিল।। কিন্তু বর্তমান মসজিদের দখলে মাত্র ৩ একর জমি রয়েছে।
দৃষ্টিনন্দন এ মসজিদটির বহির্বিভাগ দৈঘ্যে ৫২ ফুট ৫ ইঞ্চি এবং ৩৯ ফুট ৮ ইঞ্চি প্রশস্ত। মসজিদটির অভ্যন্তরে ২১ ফুট ৬ ইঞ্চির বর্গাকৃতির একটি নামাজের জায়গা রয়েছে।মসজিদের দেয়াগুলো ৫ ফুট ৯ ইঞ্চি থেকে ৭ ফুট পুরো। আর মসজিদের প্রধান দরজাটি ৪ ফুট ৭ ইঞ্চি প্রশস্ত। মসজিদটিতে ৬ ফুট ৯ ইঞ্চি প্রশস্ত একটি বারান্দা ছিল, যা এখন আর নেই।মসজিদটিতে মোট ১০টি দরজা থাকলেও বর্তমানে দরজার নিচের অংশে পাতলা প্রাচীর নির্মাণ করে জানালার আকৃতি করা হয়েছে। মসজিদের পশ্চিম দিকের দেয়ালে তিনটি অলংকৃত মেহরাব রয়েছে। মাঝখানের মেহরাবটি প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী কিছুটা বর্হিবর্ধিত এবং পাশবর্তী দুটি থেকে আকারে বড়। এর অলংকরণগুলো সুন্দর। মসজিদের সামনের অংশের কিছু জায়গা প্রাচীর দিয়ে নামাজের জন্য নির্ধারিত করা হয়েছে। জুমার নামাজসহ বিশেষ সময়ে যখন মসজিদে ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি মানুষ নামাজ পড়তে আসেন তখন ওই স্থানেও মুসুল্লিরা নামাজ আদায় করেন। মসজিদের সঙ্গে লাগোয়া ভাবে একটি ঈদগাহ আছে।
১৯৬৫ সালে কালিগঞ্জ উপজেলার মুকুন্দপুর গ্রামের আলহাজ সোহরাব আলী মসিজদটির সংস্কার করেন।
সুলতানী আমলে নির্মিত প্রবাজপুর শাহী জামে মসজিদ একটি প্রাচীন এবং স্থাপনা, যা ইসলামী ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। দেশ ও দেশের বাইরের অনেক পর্যটক এখনও মসজিদটি দেখার জন্য সেখানে ভীড় করেন।
যেভাবে যাবেন প্রবাজপুর শাহী জামে মসজিদে : দেশের যে কোন স্থান থেকে সাতক্ষীরা পৌঁছে বাস বা মোটরসাইকেল যোগে যেতে পারেন কালিগঞ্জ উপজেলায়। বাসে ৫০ টাকা, মোটরসাইকেলে ১০০ টাকায় পৌঁছানো যাবে সেখানে। এরপরে কালিগঞ্জের ফুলতলা মোড় থেকে ভ্যানে (ভাড়া ১০ টাকা) করে পাউখালি বাজারের উপর দিয়ে দেয়া স্কুল মাঠের পাশ দিয়ে প্রবাজপুর শাহী জামে মসজিদে পৌঁছানো যাবে।