আবু সাইদ বিশ্বাস : সাতক্ষীরা : ষড়যন্ত্রের শিকার দেশের মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা। সাধারণ শিক্ষার সাথে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যাপক বৈষম্যের অভিযোগ উঠেছে। প্রর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা না থাকা, মাদরাসা শিক্ষার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ, খেলাধুলা ও শরীরর চর্চার সরঞ্জাম না থাকা, ইবতেদায়িতে উপবৃত্তি ও বিনামূল্যে টিফিনের ব্যবস্থা না থাকা, ক্রিড়া ফির নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া, সরকারি চাকরিতে সুযোগ না দেয়া, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত দূরাবস্থা ও শিক্ষকদের বেতন-ভাতায় সৃষ্টি বৈষম্যের কারণে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা হুমকীর মুখে পড়েছে। এতে সাধারণ শিক্ষায় প্রতিবছর শিক্ষার্থী বাড়লেও দিনের পর দিন কমছে মাদরাসায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা। চলতি শিক্ষা বর্ষে জেলার মাদরাসাসমূহে শিক্ষার্থী ভর্তির হার খুবই কম। সারাদেশে স্কুল সমূহে নতুন বই সরবরাহ করলেও মাদ্রাসা সমূহে এখনো বই সরবরাহ করা হয়নি। ফলে চলতি ২০২১ শিক্ষা বর্ষে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়তে যাচ্ছে দেশের ৫০ লক্ষ মাদরাসা শিক্ষার্থী।
আলিয়া মাদরাসা শিক্ষার এই দিনতা দূরীকরণে বিভিন্ন সময়ে শিক্ষকদের পক্ষে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে, পরামর্শ দেয়া হয়েছে, দাবি করা হয়েছে, আন্দোলন করা হয়েছে। একটি হাইস্কুলে ছাত্র-ছাত্রী সরবরাহে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে গড়ে ৫টি। পাশাপাশি এনজি ও পরিচালিত এবং বেসরকারিভাবে (কিন্ডার গার্টেন) অসংখ্য প্রাথমিক বিদ্যালয় মানের প্রতিষ্ঠান চালু রয়েছে। অথচ মাদরাসা শিক্ষার উচ্চতর স্তরে ছাত্র-ছাত্রী সরবরাহে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ইবতেদায়ী মাদরাসা যেমন চালু নেই তেমনি যে সকল ইবতেদায়ী মাদরাসা চালু আছে তাও আজ বাঁচা-মরার সংগ্রামে লিপ্ত। পরিকল্পিতভাবে মাদরাসা শিক্ষার উচ্চ স্তরকে পঙ্গু করার উদ্দেশ্য স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসাকে ধংশ করা হয়েছে। পক্ষান্তরে বিভিন্ন সময় রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ছাত্র-শিক্ষকদের সুযোগ সুবিধা যেমন দেয়া হয়েছে তেমনি একপর্যায়ে সরকারিকরণ করা হয়েছে অপরদিকে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ীকে গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে।
ইবতেদায়ী মাদরাসা প্রতিষ্ঠার উদ্দশ্যে ছিল আলিয়া মাদরাসা শিক্ষার উচ্চতর স্তরে অধিক সংখ্যক শিক্ষার্থী নিশ্চিত করা। সেকারণে ইবতেদায়ী মাদরাসাকে বলা হয় আলিয়া মাদরাসা শিক্ষার সূতিকাগার (ফিডার ইনস্টিটিউট)। সংশ্লিষ্টরা জানান, আজকে ইবতেদায়ী মাদরাসার অবস্থা গাছের গোড়া বা শিকর কেটে মাথায় পানি ঢালার সমান।
বাংলাদেশে মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থার দু’টি প্রধান ধারা আলিয়া এবং কওমি। এছাড়া হাফেজিয়া, ফোরাকানিয়া ও ইবতেদায়ী মাদরাসা আছে। বর্তমানে সারা দেশে দাখিল, আলিম, ফাজিল ও কামিল মাদরাসা সাড়ে ৯ হাজার। এগুলোতে মোট শিক্ষার্থী ২১ লাখের মত। এ ছাড়া স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা আছে ৪ হাজার ৩১২টি। এগুলোতে শিক্ষার্থী প্রায় সাত লাখ। এ ছাড়া সারা দেশে কওমি মাদরাসা আছে ১৪ হাজারের মতো। এগুলোতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। আলিয়া মাদরাসায় আরবি বিষয়ের পাশাপাশি বাংলা ও ইংরেজিসহ সাধারণ শিক্ষার বিষয় পড়ানো হয়। বিভিন্ন সরকারি চাকরির পরীক্ষায় তাঁরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন। তবে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের সেই সুযোগ নেই। তাদের সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে হাদিসকে সাম্প্রতিক সময়ে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও নিচের স্তর স্বীকৃতির বাইরে।
১৭৮০ সালে লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংসের (১৭৩২-১৮১৮ সালে) অনুমোদনক্রমে ভারতীয় উপমহাদেশে শিক্ষার সবচেয়ে প্রাচীন নিদর্শন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় কলকাতা আলিয়া মাদরাসা। আর উপমহাদেশের প্রথম কওমি মাদ্রাসা দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৬৬ সালে। সময়ের ব্যবধানে কলকাতা আলিয়া মাদরাসা ভারত ভাগের পর ১৯৪৭ সালে ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়। ১৭৮১-১৮১৯ পর্যন্ত আলিয়া মাদরাসার বোর্ড অফ গভর্নরের সব সদস্যই ছিলেন ব্রিটিশ। ১৮১৯-১৮৫০ পর্যন্ত একটি নতুন বোর্ড অফ গভনর্রস দায়িত্ব পালন করেন একজন ব্রিটিশ সচিব এবং একজন ভারতীয় মুসলিম সহকারী সচিবের নেতৃত্বে। ১৮৫০ সালে প্রথম আলিয়া মার্দরাসার অধ্যক্ষের পদ সৃষ্টি করা হয়, এবং তাতে নিয়োগ পান ডক্টর স্প্র্যাঙ্গার. ১৮৫০-১৯২৭ পর্যন্ত আলিয়া মাদ্রাসার সব অধ্যক্ষই ছিলেন ব্রিটিশ সিভিল সার্ভিসের. ১৯২৭ সালে, প্রথম একজন ভারতীয় মুসলিম, শামসুল উলামা খাঁজা কামালুদ্দিন, আলিয়া মাদরাসার অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ পান।
স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসা এবং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যেকার বৈষম্য : ক) ১৯৮৪ সনে তৎকালীন সরকারের নির্দেশে একই স্মারকে এবং একই চিঠিতে রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ইবতেদায়ী মাদরাসার জন্ম হয়। ১৯৯৪ সালে একই পরিপত্রের মাধ্যমে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসার শিক্ষকদের মাসিক বেতন হিসেবে ৫০০ (পাঁচশত) টাকা বেতন ধার্য করা হয়। অতপর ধাপে ধাপে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি করা হলেও একই হারে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসা শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি করা হয়নি। খ) ২০১৩ সনের ৯ জানুয়ারি ২৬ হাজার ১৯৩ টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করা হয়। কিন্তু কোন স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসা ও শিক্ষকদের জাতীয়করণ তো দূরের কথা তাদের নূন্যতম প্রয়োজনটুকু পূরণের আশ্বাস পর্যন্ত দেয়া হয় নাই। গ) প্রায় ৭ হাজার এবতেদায়ী মাদরাসার শিক্ষার্থীরা ৫ম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করে থাকে এবং যেখানে ৩৪ হাজার শিক্ষক পাঠদান করেন। তন্মধ্যে মাত্র ৬ হাজার শিক্ষক নামে মাত্র বেতন (অনুদান) পেয়ে থাকেন। ঘ) সতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসার শিক্ষকরা দীর্ঘদিন (১৯৮৪ সন থেকে) দেশের শিক্ষা ক্ষেত্রে যে অবদান রেখেছেন তার মূল্যায়ন কোন সরকারই আন্তরিকতার সাথে করে নাই।
ব্যানবেইসের পরিসংখ্যান মতে ২০১২ সালে দাখিল জেডিসিতে পরীক্ষাথীর সংখ্যা ছিল ৩,৩৪,০৪৭ জন। একই বছর দাখিলে শিক্ষাথীর সংখ্যা ছিল ২,৭৩,০৬৮ জন এবং আলিমে ছিল ৮৪,২৪৬ জন। আট বছর পর দেশের জনসংখ্যা যেখানে ৩০ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে সেখানে এবং স্কুলে শিক্ষাথীর সংখ্যা ৪০ ভাগ বেড়েছে সেখোনে মাদরাসার শিক্ষার্থীও সংখ্যা বেড়েছে মাত্র ৪ থেকে ৫ ভাগ। ২০২০ সালে দাখিল (জেডিসিতে) পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৩,৮০,৪৫৯জন। একই বছর দাখিলে শিক্ষাথীর সংখ্যা ছিল ২,৭৬,৮১৫ জন এবং আলিমে ছিল ৮৬,১৩৮ জন। প্রতিবছর দাকিল থেকে কলেজে ভর্তি হচ্ছে প্রায় দেড় লক্ষ মাদ্রাসা শিক্ষার্থী। অথচ স্কুল থেকে আলিমে কোন শিক্ষার্থীও ভর্তিও সুযোগ নেই। ২০১২ সালে ঢাকা বিভাগের অধীনে এসএসসিতে অংশ নেয় ২,৩৪,১৫৫ জন এবং ২০১৯ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩,৯৩,৮৩৬ জন। অর্থাৎ একই সময়ে স্কুলের একটি বেড়ে শিক্ষার্থী বৃদ্ধি পেয়েছে ১,৫৯,৬৮১ জন। সারা দেশে প্রাথমীকে শিক্ষার্থী রয়েছে ২ কোটি ২২ লক্ষ। মাধ্যমিকে ৩ কোটি এবং উচ্চ মাধ্যমিকসহ সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রায় আরো এক কোটি শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত। সবমিলে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় যেখানে ৫০ লক্ষ শিক্ষার্থী সেখানে সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রায় সাড়ে ৬ কোটি শিক্ষাথী পড়ালেখা করছে।
এই সময়ে আলোচনার তুঙ্গে রয়েছে কওমি মাদরাসা। কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা ব্যবস্থাকে সরকার স্বীকৃতি দেওয়ার পাশাপাশি দাওরায়ে হাদিসকে সাধারণ শিক্ষার মাস্টার্স-এর সমমান ঘোষণা করা হয়েছে। যদিও অন্যান্য স্তরের মান কী হবে, তা এখনো নির্ধারণ করা হয়নি। এছাড়াও আর দাওরায়ে হাদিস-এর মান নির্ধারণ নিয়েও জটিলতা আছে। কারণ কওমি শিক্ষার মধ্যে নানা ভাগ থাকায়, কেউ ন’বছর পড়াশুনার পর আবার কেউ ১২ বছর পড়াশুনার পর দাওরায়ে হাদিস পাশ করেন।
১৮৬৬ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশে দারুল উলুম দেওবন্দ মাদরাসা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে এই উপমহাদেশে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা ব্যবস্থার শুরু। এই শিক্ষা ব্যবস্থা মূলত ইংরেজদের প্রতিষ্ঠিত আলীয়া মাদরাসাকে চ্যালেঞ্জ করে গড়ে ওঠে, তাও আবার কোনো প্রকার সরকারি সহযোগিতা ছাড়াই। বাংলাদেশের প্রধানত মসজিদকে কেন্দ্র করেই কওমি মাদরাসাগুলো গড়ে উঠেছে।এই শিক্ষা ব্যবস্থার যে কোনো পর্যায় থেকে সাধারণ শিক্ষার সমমানে প্রবেশের সুযোগ নেই। তাছাড়া বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগ বলতে কিছু নেই। সর্বোচ্চ দাওরায়ে হাদিস শ্রেণীতে হাদিসের ওপর ১০টি বিষয় পড়ানো হয় আরবিতে। আর একেই মাস্টার্সের সমমান ঘোষণা করা হয়েছে।
হাইস্কুলের ধর্ম বিষয়ে সহকারী শিক্ষকদের মতো মাদরাসার সহকারী মৌলভীদের বেতন ভাতাসহ সব সুযোগ দিতে হবে বলে হাইকোর্ট রায় ঘোষণা করলেও তা আজও বাস্তবায়ন হয়নি। রায়ে বলা হয় ‘সারা দেশের প্রায় এরকম ১০ হাজার শিক্ষক রয়েছেন। আদালতের রায়ের পর সবাই এখন থেকে স্কুলের শিক্ষকদের মতো বেতনসহ সকল সুযোগ সুবিধা পাবেন। হাইস্কুলের ধর্ম বিষয়ে (কামিল পাস) সহকারী শিক্ষকরা বেতনসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পান ২২ হাজার থেকে ২৪ হাজার টাকা। অপরদিকে মাদরাসার সহকারী মৌলভী (কামিল পাস) পান ১৬ হাজার টাকা।
তবে শিক্ষার্থী সংখ্যা কমার পরিসংখ্যানের সঙ্গে একমত নয় মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড। মাদ্রাসা বোর্ড বলছে সাধারণ শিক্ষার সঙ্গে আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষার তেমন পার্থক্য নেই। তবে এই শিক্ষার আরো আধুনিকায়নে সামনে উদ্যোগ নেবে সরকার।
Check Also
সাতক্ষীরায় পুত্রবধূর হাতে নির্যাতিত সেই স্কুলশিক্ষক মারা গেছেন
ক্রাইমবাতা রিপোট, সাতক্ষীরা: ছেলে ও পুত্রবধূর হাতে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতনের শিকার সাতক্ষীরা সদর উপজেলার বাঁশতলা …