শহর ও গ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন একটি গ্রামের নাম গোলাখালী। গ্রামটি সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার রমজানগর ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডে অবস্থিত। যে গ্রামটি মূলত একটি দ্বীপের মধ্যে মাদার নদীর তীরে অবস্থিত।
দেশের সর্ববৃহৎ উপজেলা শ্যামনগর। এ উপজেলার সর্বশেষ দক্ষিণে সুন্দরবনের কোল ঘেষে অবস্থিত এই গ্রাম। আধুনিকতা নয়, বরং সাধারণ জীবন যাপনের কোন ব্যবস্থাই নেইএখানে। এই গ্রামে নেই কোন ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। নেই চিকিৎসা ব্যবস্থা, স্বাস্ব্যসম্মত ল্যাটিন, কোন উপাসনালয়, এমনকি জীবন ধারনের জন্য খাদ্য সংগ্রহের জন্য কোন বাজার ব্যবস্থা। এই এলাকার জনগনের একমাত্র উপার্জন হলো নদী থেকে মাছের পোনা ধরা।
অবস্থান: শ্যামনগর উপজেলা থেকে ১২ কি. মি. দক্ষিনে ভেটখালী বাজার। সেখান থেকে ১২ কি.মি. দক্ষিণ-পূর্বে ধজিখালী নদী পার হয়ে গোলাখালী গ্রাম। এই গ্রামের পূর্বপাশে সুন্দরবন। পশ্চিমে মাদার নদী, কালিনচী নদী ও ভারত। উত্তরে ধজিখালী নদী এবং দক্ষিণে মাদার নদী। এই গ্রামে ১০৫ টি পরিবারের ৩৪০ জন ব্যক্তি বসবাস করে। যার ভোটার সংখ্যা ১৮০।
শিক্ষা: এই গ্রামের প্রায় শতভাগ মানুষ অশিক্ষিত। এখানে কোন স্কুল কলেজ, মাদ্রাসা বা গণশিক্ষার কোন ব্যবস্থা নেই। পার্শ্ববর্তী গ্রামে কালিঞ্চী এ গফ্ফার প্রাইমারি স্কুল রয়েছে। যা ঐ গ্রাম থেকে ৬ কি.মি দূরে। দূর্গম পথ হওয়ায় ছেলে- মেয়েরা স্কুলে যেতে চায়না। আর দরিদ্রতার কারণে অভিভাবকরাও ছেলে- মেয়েদের স্কুলে পাঠানোর জন্য চেষ্টা করেনা।
গোলাখালী মধ্যপাড়ায় একটি মসজিদ রয়েছে। যেখানে দুপুরের পরে দুর-দুরান্ত থেকে ছেলে মেয়েরা আরবী পড়ার জন্য আসে। এখানে স্বেচ্ছাসেবী জহুরা খাতুন নামের এক মহিলা রয়েছে। যিনি কায়দা, আমপারা ও কোরআন শরীফ শিক্ষা দেন। কিন্তু তিনিও একজন কর্মজীবি বিধায় নিয়মিত পড়াতে পারেননা।
ধর্ম: দ্বীপ গ্রাম বলে পরিচিত এই গোলাখালী গ্রামের অধিকাংশ মানুষ মুসলিম। তার মধ্যে ৬ ঘর হিন্দু ধর্মাবলম্বী রয়েছে। ১৯৯৫ সালে মাদার নদীর পশ্চিম পার্শ্বে স্থানীয়রা স্বল্প আকারে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। বিগত আম্পান ঝড়ে মসজিদটির ৭৫ ভাগ ধ্বংশ হয়ে যায়। এলাকায় অন্য কোন মসজিদ না থাকায় ঐ ভাঙ্গা মসজিদেই নামাজ পড়েন মুসল্লি¬রা। কিন্তু বৃষ্টি হলে মসজিদে আর নামাজ পড়া সম্ভব হয় না।
সম্প্রতি এলাকার ফরিদ উদ্দীন গাজী নামে এক ব্যক্তি ৫ কাঠা জমি দান করেছেন। যেখানে এলাকাবাসী মাটি ভরাটও করেছে। এলাকাবাসী জানায়, সাতক্ষীরার আলহাজ্ব আব্দুল রশিদ নামের এক ব্যক্তি মসজিদটি নির্মাণের ওয়াদা দিয়েছেন। এলাকার উজ্জ্বল কুমার মন্ডল জানান, এখানে ৬ ঘর হিন্দু ধর্মাবলম্বী রয়েছে যার লোক সংখ্যা ২৫ জন। এখানে একটি পুজা ঘর রয়েছে যা স্থানীয়রা সংস্কার করেছে।
চিকিৎসা: এই গ্রামে কোন কমিউনিটি ক্লিনিক, সাধারণ ক্লিনিক, গ্রাম ডাক্তার বা ঔষধের দোকান নেই। জরুরী প্রয়োজনে নদী পার হয়ে পায়ে হেটে বা মোটর সাইকেল ভাড়া করে ১২ কি.মি. পথ পাড়ি দিয়ে ভেটখালী বাজার থেকে ডাক্তার দেখানো বা ঔষধের ব্যবস্থা করতে হয়। কোন গর্ভবতী মহিলাকে বাড়ী থেকে উচু-নিচু পথ পার হয়ে একমাত্র নৌকা যোগে নদীর মোহনায় নেমে মোটর সাইকেল যোগে ভেটখালী বাজার বা ২৪ কি.মি. দূরে শ্যামনগর উপজেলা সদরে আনতে হয়।
হাটবাজার: গোলাখালী, কালিনচী মুন্ডাপাড়া, কালিনচী কলোনীপাড়া, কালিঞ্চী চরপাড়া ও কালিনচী গেট পাড়া গ্রামে কোন হাট বা বাজার নেই। এসব গ্রামের মানুষের ভেটখালী বাজার থেকেই তরিতরকারী বা খাদ্য সংগ্রহ করতে হয়। তবে গোলাখালী গ্রামের লোক সপ্তাহে একবার বাজার করে।
কবরস্থান: দ্বীপ গ্রাম এই গোলাখালী গ্রামে কোন কবরস্থান নেই। কোন মানুষ মারা গেলে নৌকা যোগে নদী পার করে ১৪ কি.মি লাশ ঘাড়ে নিয়ে ভেটখালী বাজারের পশ্চিম পাশে শোরা গ্রামের একটি কবরস্থানে দাফন করতে হয়। এজন্য ঐ কবরস্থান কমিটিকে পাঁচ শত থেকে এক হাজার টাকা প্রদান করতে হয়।
বাঘবিধবা: গোলাখালি গ্রামের ৯ নং ওয়ার্ডের মেম্বর সোহরাব হোসেন জানান- গোলাখালী, কালিঞ্চী মুন্ডপাড়া, চরপাড়া, গেটপাড়া, বড়খাষ খামার ও কলোনীপাড়ায় ৬১ জন বাঘ বিধবা ও একজন কুমিরে বিধবা রয়েছে। এছাড়া মোট ১৬০ জন বিধবা মহিলা রয়েছে। এদের মধ্যে ৩০ জন মহিলা বিধবা ভাতা পান। বাকী সবাই মানবেতর জীবন যাপন করছে। সোহরাব হোসেন আরো জানান, গোলাখালি গ্রামের ৮৫% লোকের জীবন জীবিকা সুন্দরবনের সাথে জড়িত।
তারা সাদা মাছ, কাকড়া ধরা ও মধু সংগ্রহ করে সসংসার চালায়। আবার সিজেন চলে গেলে খেয়ে না খেয়ে জীবন চলে। সাতক্ষীরার ইমাম সমিতির রশিদ সাহেব বর্তমানে অভাবি মানুষের কষ্ট লাঘবে কাজ করছেন। নদীতে রাত ১২টা বা ১ টার দিকে যখন ভাটা লাগে তখন নারী পুরুষ সবাই নদীতে মাছ ধরতে যায়। তিনি আরো জানান, এলাকার কামাল হোসেন খোকন ভাই এলাকা বাসির জন্য কাজ করছেন। সরকারি- বেসরকারি কোন কর্তাগন গ্রামে আসলে খোকন তাদের সহযোগিতার জন্য ব্যাকুল হয়ে যায়।
গোলাখালী গ্রামের বাঘ বিধবা রাবেয়া খাতুন (৫৫) জানায়- তার স্বামী সেকেন্দার সানা ২২ বছর আগে এক সকালে আরও কয়েকজন মিলে মাথা ভাঙ্গা নদীর পাশে ধজিখালী জঙ্গলে কাঠ কাটতে যায়। দু’ঘন্টা পর সাথে থাকা লোকজন এসে জানায় তার স্বামীকে বাঘে ধরে নিয়ে গেছে। এসময় গ্রামের আরও লোকজন ঐ জঙ্গলে চিৎকার করতে করতে আমার স্বামীকে খুজে পায় এবং তাকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করে বাড়ী নিয়ে আসে। রাবেয়া আরও জানায়, তার দুই পুত্র সবাই আলাদা। এক মেয়ে অন্যের ঘরে। বর্তমানে নদীতে জাল টানেন তিনি। দিনে ২০ থেকে ৪০ টাকা আয় হয় কোন দিন হয় না। অতিকষ্টে দিন চলে তার।
এই গ্রামে চাষাবাদের কোন জমি নেই। সব নদী ও ঘের। এর মধ্যে ৬৪ বছরের ফরিদ উদ্দীন চাচা নিজ বাড়ীর পাশেই উচু স্থানে লাগিয়েছেন লাল শাক, পুঁইশাক, পালং শাক, ওলকপি ও লাউ। তিনি জানান, জমি নিচু হওয়ায় এখানে কোন সবজি চাষ হয়না। তবে জমি উচু করে চাষ করলে সবজি চাষ সম্ভব।
সমাজ সেবক এবং প্রবাসীদের সাথে ত্রান সমন্বয়কারী, জেলা ইমাম সমিতির সভাপতি আলহাজ্ব আব্দুর রশিদ জানান, আম্পান পরবর্তী সময়ে তিনি দেশের ও প্রবাসীদের সাথে যোগাযোগ করে তাদেরকে ক্ষতিগ্রস্তদের বিভিন্ন তথ্য দিয়েছিলেন। প্রতাপনগর, গাবুরা, পাতাখালী, কয়রা ও মদিনাবাদ এলাকার ১০৫ জন দুস্থ ও ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারকে ১০ হাজার করে টাকা প্রদান করেন।
পরবর্তীতে ঐ সমস্ত দাতাদের সহযোগিতায় আরও দুই শ’ পরিবারকে ৫ হাজার টাকা করে নগদ প্রদান করা হয়। ১১ জন বিধবা মহিলাকে ঘর তৈরী করে দেওয়া হয়েছে। এলাকায় ৪টি টয়লেট নির্মাণ ও ৭ টি ডীপ টিউবওয়েল বসানো হয়েছে। ১২ জন দরিদ্র ব্যক্তিকে ৪ টি জাল ও ৪টি নৌকা দেওয়া হয়েছে। বাঁধ সংস্কার করার জন্য ৮০০ পিস বাঁশ ও ১৩ হাজার বস্তা দেওয়া হয়েছে। এগার শ’ ব্যক্তিকে শীতবস্ত্র ষোল শ’ ব্যক্তির প্রত্যেকের ১২ কেজি করে চাল, ডাল আলু পেয়াজ ও ভোজ্য তেল দেওয়া হয়েছে।
বর্তমানে দ্বীপ গ্রাম বলে পরিচিত গোলাখালী গ্রামের মানুষের শিক্ষা, চিকিৎসা, যাতায়াত ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা নিয়েছি। এই গ্রামে যাদের ঘর বাড়ী নেই সমর্থের মধ্যে তাদের বাড়ী নির্মাণ, একটি মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আমরা প্রবাসি ভাইদের সাথে যোগাযোগ করে কিছু টয়লেট ঘর নির্মান এবং ফ্রি চিকিৎসা সেবা প্রদানের প্রস্তুুতিও নিয়েছি। তিনি দেশের স্বচ্ছল ও বিত্তবান ব্যক্তিদের ঐ এলাকার মানুষের পাশে দাড়ানোর জন্য উদাত্ত্ব আহ্বান জানান।
রমজানগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ আল মামুন জানান, গোলাখালী গ্রামটি পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়ি বাঁধের বাইরে। তাই চেষ্টা করছি পানি উন্নয়ন বোর্ডের মধ্যে আনার জন্য। একটি বাঁধ নির্মিত হলে বাঁধটি রাস্তা হিসেবে ব্যবহার হবে এবং গোলাখালি বাসিও জ্বলোচ্ছাসের হাত থেকে রক্ষা পাবে। এখানে একটি সাইক্লোন সেল্টার দরকার। জরুরী মুহুর্তে ঐ এলাকার লোকদের সরিয়ে নেওয়া সম্ভব হয় না।
তাছাড়া সাইক্লোন সেল্টার নির্মাণ হলে এলাকার ছেলে মেয়েদের সেখানে লেখাপড়ার ব্যবস্থা করা যাবে। বাঘ বিধবা সম্পর্কে তিনি বলেন, সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী সকল বাঘ বিধবাদের রেজিষ্ট্রেশন করা হয়েছে। তিনি গোলাখালীসহ নিন্মাঞ্চলের মানুষের সহযোগিতার জন্য সরকারসহ বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।