মানবিক গুণাবলী অর্জনে পবিত্র আল-কুরআন বিলাল হোসেন মাহিনী

মানব শিশুকে মানবিক গুণাবলী সমৃদ্ধ মানুষ হিসেবে তুলতে পিতা-মাতা, পরিবার ও সমাজের ভূমিকা অপরিসীম। আজকের সমাজে মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন মানুষের বড়োই অভাব। এখন মানুষের মধ্যে সৃষ্টিকর্তার প্রতি আস্থা-বিশ্বাস ও তাকওয়ার অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। পাশবিকতা জেঁকে বসেছে মানুষের চৈতণ্য জুড়ে। অশ্লীলতা, সীমালঙ্ঘন, হত্যা, চুরি-ডাকাতি ও বিশ্বাসঘাতকতা বেড়েই চলেছে। অপরের হক আদায় ও পরমতসহিষ্ণুতা অন্যতম মানবিক গুণাবলী হলেও তা এখন লিখিত পুস্তক ও বক্তৃতা-বিবৃতিতে সীমাবদ্ধ।
জ্ঞান অর্জনে মানুষের সদিচ্ছার অভাব প্রকট। যখন মানুষের শুভবুদ্ধি ও সদিচ্ছা দুর্বল হয়, তখনই সে মন্দের প্রতি ধাবিত হয়। যা সমাজজীবনকে নষ্ট করে, মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনকে বস্তুগত ও আত্মিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করে, বরং যখন কোনো মন্দ বিষয় কোনো জাতির ভেতর ছড়িয়ে পড়ে তা সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য ধ্বংসের কারণ হয়ে ওঠে।
সামাজিক স্খলনের কারণ বর্ণনা করে পবিত্র কুরআনে বর্ণনা করা হয়েছে ‘আল্লাহ তোমাদের ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ ও আত্মীয়-স্বজনকে দানের নির্দেশ দিচ্ছেন। তিনি নিষেধ করছেন অশ্লীলতা, অসৎ কাজ ও সীমা লঙ্ঘন; তিনি তোমাদের উপদেশ দেন যেন তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করো।’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ৯০) উল্লিখিত আয়াতে সামাজিক পতনকে তিন শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়েছে। এক. অশ্লীলতা বা নির্লজ্জতা, দুই. মন্দ কাজ যাতে সমাজ ক্ষতিগ্রস্থ হয়, তিন. সীমালঙ্ঘন ও অবাধ্যতা। যেমন-হত্যা, চুরি, ডাকাতি, মানুষ, সমাজ ও রাষ্ট্রের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা ইত্যাদি। এই তিন প্রকার অন্যায় ও পাপ সব ধর্ম ও সমাজে সমভাবে নিন্দনীয়। প্রকৃতপক্ষে কাজগুলো মন্দই। ধর্ম ও মনুষ্যত্বের বিচারেও তা পাপ ও ঘৃণ্য। যদি এই তিন শ্রেণির অপরাধ বৈধতা পায়, তবে মানুষের পারস্পরিক অধিকার; জীবন, সম্পদ ও সম্ভ্রম নিরাপদ থাকবে না।

সমাজ সংস্কারে চারটি মানবিক গুণ :
পবিত্র কুরআন এসব পাপ ও মন্দ স্বভাবের বিপরীতে ভারসাম্যপূর্ণ মানবীয় গুণাবলি অর্জনের কথা বলেছে। এসব গুণের প্রসার ও চর্চার মাধ্যমেই ইসলাম সমাজ সংস্কারের কথা বলে এবং সমাজকে স্খলনের হাত থেকে রক্ষা করে। কুরআনে বর্ণিত এমন কিছু গুণের বর্ণনা নি¤েœ তুলে ধরা হলো।

এক. খোদাভীতি : আল্লাহভীতি তথা তাকওয়া হলো জীবনযাপনে সৎ ও পবিত্র হওয়া। আল্লাহভীতি মানুষকে ন্যায়বিচার ও ইনসাফ, চারিত্রিক পবিত্রতা, বিনয় ও বিন¤্রতা, ভারসাম্য ও মধ্যপন্থা, সততা ও সৃষ্টির প্রতি দয়াশীল হতে শেখায়। কোনো মানুষের ভেতর আল্লাহভীতি না থাকলে সে লোভ-লালসা, অশ্লীলতা, অপব্যয়, সুদ, ঘুষ, মিথ্যাচার, ওজনে কম দেওয়া, পরনিন্দার মতো মন্দ কাজে লিপ্ত হয়। কুরআন এসব কাজকে অশ্লীলতা ও মন্দ কাজের শ্রেণিভুক্ত করেছে। এসব মন্দ কাজের চিকিৎসাও ইসলাম দিয়েছে। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই নামাজ অশ্লীলতা ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে। আর আল্লাহর স্মরণই তো সর্বশ্রেষ্ঠ।’ (সুরা : আনকাবুত,   আয়াত : ৪৫)
দুই. লজ্জা ও শালীনতা : অশ্লীলতা ও নির্লজ্জতার চিকিৎসা লজ্জা ও শালীনতা। ইসলাম লজ্জা ও শালীনতার নির্দেশ দিয়েছে, তবে সত্য প্রকাশে নয়। মানুষ লজ্জা করবে পাপ ও অন্যায় কাজে, যাতে সমাজ থেকে মন্দ দূর হয়। সমাজে লজ্জা ও শালীনতার চর্চা না থাকলে সেখানে মানুষ যা খুশি করতে পারে। নিয়মিত সালাত একই সঙ্গে মানুষের ভেতর লজ্জাবোধ বাড়ায় এবং মন্দ কাজ থেকে দূরে রাখে। পাশাপাশি সিয়াম তথা রোজা পালনের মাধ্যমেও নিজেকে পরিশুদ্ধ করা সম্ভব।
তিন. সুবিচার : মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র ন্যায়ানুগ হওয়া অত্যাবশ্যক। ইনসাফ তথা ন্যায়বিচার বিবেকের শক্তি ও ভালো কাজের দীপ্তি। মানুষ যখন প্রবৃত্তির ভারে নিষ্প্রভ হতে থাকে, তখন ন্যায়ানুগ হওয়া প্রয়োজন। অবশ্য কিছু মন্দ কাজ এমন, যার কারণে অল্লাহ তাঁর অনুগ্রহ ছিনিয়ে নেন, যা মানুষকে আল্লাহর ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করে, ফলে সে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভে ব্যর্থ হয়। যেমন-শিরক, সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে উপাস্য হিসেবে জ্ঞান করা। যে ব্যক্তি শিরকে লিপ্ত হয়, সে চিরদিনের জন্য আল্লাহর অনুগ্রহ হারিয়ে ফেলে। যদি না সে তাওবা করে এবং নতুন করে ঈমান আনে। এ জন্য ইসলাম সব মিথ্যা উপাস্যকে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং আল্লাহর একত্ববাদের আহ্বান জানিয়েছে।

চার. মন্দের বিপরীতে ভালো কাজ করা : সমাজসংস্কারে কুরআনের আরেকটি মূলনীতি হলো মন্দের পরিবর্তে ভালো কাজ করা, ভালো করতে উৎসাহিত করা। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘ভালো ও মন্দ কখনো সমান হতে পারে না। মন্দ প্রতিহত করো ভালো দ্বারা। ফলে তোমার সঙ্গে যার শত্রুতা রয়েছে সে হয়ে যাবে তোর অন্তরঙ্গ বন্ধুর মতো।’ (সুরা : হা-মিম সাজদা, আয়াত : ৩৪) অর্থাৎ ভালো ও মন্দ কর্ম কখনো সমান নয়। কেউ মন্দ কর্ম করলে তার বিপরীতে তার সঙ্গে ভালো করতে হবে। কেননা মূর্খদের উপেক্ষা করা এবং তাদের সঙ্গে ভালো আচরণ করা সওয়াবের কাজ। আল্লাহ ভালো আচরণের প্রতিদান নষ্ট করেন না; বরং ভালো আচরণের মাধ্যমে সমাজের মন্দ প্রবণতা দূর হয়। তাই সমাজসংস্কারে ক্ষমা ও উদারতা প্রদর্শন করতে হবে। এতেই সমাজের বহু মন্দ প্রবণতা দূর হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই ভালো কাজগুলো মন্দগুলোকে দূর করে।’ (সুরা : হুদ, আয়াত : ১১৪)

মন্দ কর্মের পরিবর্তে ভালো দ্বারা নিজেকে সুশোভিত করার বহু দৃষ্টান্ত পবিত্র কুরআনে রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘রহমানের বান্দা তারাই, যারা পৃথিবীতে ন¤্রভাবে চলাফেরা করে এবং তাদের যখন মূর্খ লোকেরা সম্বোধন করে, তখন তারা বলে সালাম। .. যখন তারা ব্যয় করে, তখন অপব্যয় করে না, কার্পণ্যও করে না; বরং তারা আছে এই দুইয়ের মধ্যে মধ্যম পন্থায়।’ (সুরা : ফোরকান, আয়াত : ৬৩ ও ৬৭) এ ছাড়া সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষায় ইসলাম যেসব গুণ অর্জন করতে বলে এর মধ্যে আছে ইখলাস, তাওয়াক্কুল, সবর ও শোকর। ইখলাস হলো শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করা। তাওয়াক্কুল আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস রাখা। সবর হলো সব আশা ও নিরাশায় আল্লাহমুখী থাকা এবং তাঁর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন করা। আর শোকর হলো আল্লাহ ও মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ। মনে রাখতে হবে, মানুষের অধিকার (হক) সবার উপরে।
বিলাল মাহিনী
পরীক্ষক : ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
প্রভাষক : গাজীপুর রউফিয়া কমিল মাদরাসা, যশোর।

Check Also

সাতক্ষীরায় বিজিবির অভিযানে দশ লাখ টাকার মালামাল আটক

সাতক্ষীরা ও কলারোয়া সীমান্তে চোরাচালান বিরোধী বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে মাদকদ্রব্যসহ প্রায় দশ লক্ষ টাকার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।