চরম অভাব দেখা দিয়েছে সাতক্ষীরায়: সবজির পরিবর্তে খাচ্ছে আলু

ক্রাইমবাতা রিপোট  , সাতক্ষীরাঃ অভাব অনাটনে, খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরার অসংখ্য মানুষের। আশ্বিন-কার্তিকের আকাল, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে এখানকার কৃষক পরিবারের মধ্যে চরম খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। আমন ধান এখনো মাঠে থাকায় হাতে কোনো কাজ নেই কৃষকদের। ফলে চরম আর্থিক সংকটে পড়েছেন জেলার নিন্ম আয়ের কয়েক লক্ষ পরিবারের মানুষ। নি¤œ আয়ের বড় অংশ এখন খাবার কিনতে হিমশিম খাচ্ছে। খাবার কেনার জন্য কেউ কেউ পরিবারের কোনো সম্পদ বিক্রি করছেন। কেউ কেউ ঋণ করছেন। নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়া এবং আয় কমে যাওয়ায় নানাভাবে সাশ্রয়ের চেষ্টা করছে। সবজির দাম বেড়ে যাওয়ায় বেশির ভাগ মানুষ আলু খাওয়ার পরিমাণ বাড়িয়েছেন। ৩০ টাকা কেজি প্রতি ওএমএসের চাল কিনতে সকাল থেকে দীর্ঘ লাইন দেখা যাচ্ছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির তথ্য মতে আগস্ট মাসে বাংলাদেশে খাদ্য কেনার জন্য ৬৪ শতাংশ মানুষ ঋণ নিয়েছেন। ২৯ শতাংশ পরিবার তাদের সঞ্চয় ভেঙেছে। আবার খাবার কিনতে গিয়ে ১০ শতাংশ পরিবার তাদের গত ১২ মাসের সব সঞ্চয় ভেঙে ফেলেছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির প্রতিবেদন বলছে মাছ, মাংস, সামুদ্রিক খাবারসহ পুষ্টিকর উপাদানসমৃদ্ধ খাবার পর্যাপ্ত পরিমাণে খেতে পারছে ১৭ শতাংশ পরিবার। ফলে স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেকার হয়ে পড়া এসব লাক্ষ জনগোষ্ঠীর এখন দিন কাটছে খেয়ে না খেয়ে। খাবার জোগাতে অনেকে আগাম শ্রম বিক্রি করে দিচ্ছেন। যারা ধান রোপণ, ধানকাটা-মাড়াই অথবা ইটভাটায় কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন তাদের ভাদ্র-আশ্বিন-কার্তিকে কোনো কাজ থাকে না। তখন চরম আর্থিক দৈন্যদশার মধ্যে দিনাতিপাত করেন তারা। সাতক্ষীরা জেলা কৃষি বিভাগের তথ্য মতে ৩৮১৭.৩০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা বিশিষ্ট জেলায় ২৩ লক্ষের বেশি মানুষের বসবাস। জেলাতে মোট ৩ লক্ষ ৫৮ হাজার ৫৫০টি কৃষক পরিবার রয়েছে। যাদের ৫ শতাংশের নীতে জমি আছে এমন ভুমিহীন পরিবারের সংখ্যা ৬৭ হাজার ২৩০টি। প্রান্তিক চাষি পারিবারের সংখ্যা এক লক্ষ ৩১ হাজার ৩৭টি। ক্ষুদ্র চাষী পরিবার রয়েছে এক লক্ষ ৯৫৭টি। এতে ২ লক্ষ ৯৯ হাজার ২২৪টি পারিবারের ১১ লক্ষ মানুষ কৃষির উপর জীবিকা নির্বাহ করে। বছরের বেশির ভাগ সময়ে যাদের ঘরে খাদ্য শস্য থাকে না। কৃষি নির্ভর অর্থনীতিতে খাদ্যের ভূমিকায় তারা অত্যন্তগুরুত্বপূণ অবদান রাখে। অথচ বছরের তিনটি মাস (ভাদ্র-আশ্বিন-কার্তিক) মাসে তাদের সংসার চলে চরম অভাবে।

বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির ‘বাংলাদেশে খাদ্যনিরাপত্তা ও বিপন্নতা পর্যবেক্ষণ’ শীর্ষক প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, সামগ্রিকভাবে দেশের ২২ শতাংশ মানুষ মাঝারি মাত্রায় খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় রয়েছেন (আগস্টে)। হারটি আগের মাস জুলাইয়ের চেয়ে কম। ওই মাসে ২৯ শতাংশ মানুষ মাঝারি মাত্রায় খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ছিলেন। আর নিম্ন আয়ের ৪২ শতাংশ পরিবারের জীবনযাত্রা এবং খাদ্য পরিস্থিতির সব ক্ষেত্রে অবনতি হয়েছে। এই পরিস্থিতির জন্য মূলত খাদ্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃ দ্ধি, জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে দেওয়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং রোগবালাইয়ের মতো স্বাস্থ্যসমস্যা বেড়ে যাওয়াকে দায়ী করা হয়েছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির প্রতিবেদনে বলা হয়, নিম্ন ও মধ্যম আয়ের পরিবারগুলো নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়াসহ নানা ধরনের চাপ সামলাতে পারছে না। এসব সমস্যা তাদের ভবিষ্যতের বড় সংকট মোকাবিলার সামর্থ্য কমিয়ে দিচ্ছে। তবে ধনী ও সচ্ছল পরিবারগুলো খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়াসহ অন্যান্য সমস্যায় তেমন কোনো অসুবিধায় পড়েনি।
খাদ্যসংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকারের নেওয়া নানা উদ্যোগের চিত্র তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, বেসরকারি খাতে চালের সরবরাহ বাড়াতে ও দাম কমাতে সরকার আমদানি শুল্ক কমিয়ে দিয়েছে। বেসরকারি খাতের মাধ্যমে ১২ লাখ টন চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। সরকারিভাবে রাশিয়া ও ভিয়েতনাম থেকে গম ও চাল আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ৫০ লাখ গরিব মানুষের জন্য বিশেষ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি শুরুকরেছে সরকার। সরকারের নেওয়া এতসব উদ্যোগের পরেও চাল ও গমের দাম যেমন বেড়েছে, তেমনি সবজি, ডিম, ডাল, মাছ, চিনি, পেঁয়াজ, আদা, রসুন ও হলুদের দাম নিয়মিতভাবে বৃ দ্ধি পেয়েছে। জুলাই ও আগস্টে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। মূল্যস্ফীতির ওই চাপ সামলাতে নিম্নবিত্ত ও মধ্যম আয়ের মানুষ খাদ্য কেনার পরিমাণ কমিয়ে দিচ্ছেন।
বিশ্লেকরা বলেন রাষ্ট্রের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব হলো সব সময়ে সবার জন্য নিরবচ্ছিন্ন খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা। কিন্তু ক্রমাগত প্রাকৃতিক দুর্যোগ, খাদ্য উৎপাদন ও চাহিদার সমন্বয়হীনতার অভাবে ক্রমে প্রকট হয়ে উঠছে খাদ্য সংকট। কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ফলে আবাদযোগ্য জমি কমার কারণে গত ১০ বছরে জমির পরিমাণ ও উৎপাদন ২০ থেকে ৩৭ শতাংশ পর্যন্তকমেছে। কৃষি খাতকে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি ১৫.১৮ মিলিয়ন (বিবিএস, কৃষি শুমারি ২০০৮) কৃষি পরিবারের (যাদের মধ্যে ৮৪.৩৮ শতাংশ পরিবারে জমির পরিমাণ সর্বোচ্চ ১ হেক্টর) জীবিকা অর্জনে কখনও কখনও অসম পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
জেলাতে কর্মসংস্থানের জন্য বিপুলসংখ্যক গরিব ও ভূমিহীন পরিবারের কৃষি খাতের ওপর নির্ভরশীলতার কারণে পরিস্থিতির জটিলতা আরও বেড়েছে। সাতক্ষীরা শহরের বাগানবাড়ি এলাকার কামরুজ্জামান জানান, ঘরে খাবার নেই। কাজ কামও নেই। কি করবো। ঋধ দায়েক করে কোন রকমে চলছি। ৩০ টাকা দরে চাল কিনতে দীর্ঘ লাইন দিতে হচ্ছে। খুব ভোরে আসি আর ১১টার দিকে ৫ কেজি চাল নিয়ে বাড়ি যায়। সেই চাল রান্না বান্না করে ছেলে মেয়ে নিয়ে খাই। কাজ থাকলে এভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে চাল তুলতাম না।

 

Please follow and like us:

Check Also

আশাশুনির বদরতলা-ব্যাংদহা সড়কে পল্লী বিদ্যুতের পরিত্যাক্ত খুটির রড: l দুর্ঘটনার শঙ্কা

এস,এম মোস্তাফিজুর রহমান( আশাশুনি) সাতক্ষীরা।। আশাশুনি উপজেলার শোভনালী ইউনিয়নের বদরতলা টু ব্যাংদহা সড়কে পল্লী বিদ্যুতের …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।