বিপন্নের পথে সুন্দরবন: বিলিন হচ্ছে ৭৫ শতাংশ এলাকা

আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরাঃ বিপন্নের পথে সুন্দরবন। সমুদ্র উপকূলবর্তী নোনা পরিবেশের বিশে^রে সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনের দাবিদার এই সুন্দরবন আজ বিলিন হতে চলেছে। রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মান, গ্রীনহাউজ ইফেক্টে, জলীয় বাষ্পের বিরূপ প্রভাবে পৃথিবীর উষ্ঞতা বৃদ্ধিতে পৃথিবীর দুই মেরুতে সঞ্চিত বরফ গলতে শুরু করেছে। এতে সুমদ্রের পানি দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে সুন্দরবনের পানির উচ্চতা বিপজ্জনক হারে বাড়ছে। বছরে এই বৃদ্ধির হার তিন থেকে আট মিলিমিটার। বিজ্ঞানিরা বলছে, তাপমাত্রা যত বৃদ্ধি পাচেছ পানির বাষ্পীভবনের হারও তত বাড়ছে। ফলে গ্রীনহাউজ ইফেক্টে জলীয় বাষ্পের প্রভাবও বেড়ে যাচেছ। এছাড়া শিল্পউন্নত দেশ গুলোর নিয়ন্ত্রনহীন আধিপত্যের কারণে বাংলাদেশের মত অনুন্নত দেশ এর কবলে চরম ক্ষতি গ্রস্থ হচেছ। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে পুথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের পানির উচ্চতা বিপজ্জনক হারে বাড়ছে। এতে জীববৈচিত্র্যও হুমকির মুখে পড়তে শুরু করেছে। সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা আর ৪৫ সেন্টিমিটার বাড়লে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে থাকা সুন্দরবনের ৭৫ শতাংশ এলাকা বিলীন হয়ে যাবে বলে জানানো হয় এক প্রতিবেদনে। বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের চলমান ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যেই বাংলাদেশের উপকুলীয় অঞ্চলের ১৪ শতাংশ এলাকার মাটির নিচের পানিতেই মাত্রারিক্তি লবনাক্ততা দেখা দিবে বলে ওই গবেষণায় ভবিষ্যদ্বানী করা হয়েছে। ‘গবেষণায় দেখা গেছে ২০৫০ সালের মধ্যে উপকুলীয় অঞ্চলের আরো ২.২৭ শতাংশ এলাকার মাটির নিচের পানি লবনাক্ততার ফলে দূষিত হয়ে পড়বে। আর বিশুদ্ধ পানির অঞ্চলের পরিমাণ কমে আসবে ৩.৪৪ শতাংশ। জলবায়ু পরিবর্তন ও কিছুসংখ্যক মানুষের অপরিণামদর্শী এবং বনবিরোধী কার্যক্রমের কারণে সুন্দরবন আজ বিপন্ন।
বিশেজ্ঞরা বলছে, সুন্দরবন ধ্বংস করে ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের চেষ্টা করা হচ্ছে । যে বিদ্যুৎ দিয়ে রামপাল থেকে মংলা পর্যন্ত একটি সিন্ডিকেটে জমি দখল করে শিল্প কারখানা গড়ে তুলেছে। সেই কারখানায় বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তুলার উদ্যোগ নিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছে,কয়লা উৎপাদন করতে সুন্দরবনের প্রচুর গাছ কাটা হতে পরে। বিশেজ্ঞরা বলছে, ভারত ও বাংলাদেশের এবং জাতিসঙ্ঘের পরিবেশ সংশ্লিষ্ট সকল আইন, নীতি ও ঘোষণাকে উপেক্ষা; বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রদান, ও আর্থিক হিসেবের বিচারে অনেক ক্ষতির দায় মাথায় নিয়ে স্থানীয় ও সারাদেশের কোটি কোটি মানুষের প্রতিবাদ উপেক্ষা করে বাংলাদেশ ও ভারত সরকার এই বিশাল আকারের বিদ্যুৎ কেন্দ্র্র স্থাপন কাজ চলমান রেখেছেন। অথচ বৈজ্ঞানিকভাবে এটি পরিস্কারভাবে প্রমাণিত যে, রামপাল প্রকল্প সুন্দরবনকে ধ্বংস করবে। রামপালের কয়লা থেকে নির্গত পদার্থ বনের মাটি, পানি ও বাতাসকে মারাত্মকভাবে দূষিত করবে এবং পশুপাখি-মাছ-ডলফিন মারা যাবে বা ভেগে যাবে বলে জানান তিনি।
সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে অতিরিক্ত নৌ চলাচলের ফলে অধিক তেল নিঃস্বরণ, শব্দদূষণ, বর্জ্য নিঃসরণ ইত্যাদরি ফলে ইকো সিস্টেম বিশেষ করে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণ, ডলফিন, ম্যানগ্রোভ বন ইত্যাদির উপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। ড্রেজিং এর ফলে নদীর পানি ঘোলা হচ্ছে এবং তেল, গ্রীজ নি:সৃত হয়ে জলজ প্রাণী মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়ছে। আবার জেটি নির্মাণের জন্য নদীর ধারের সুন্দরবনের ঝোপ-ঝাড় কেটে ফেলতে হয়েছে। এর ফলে বক, সারস সহ বিভিন্ন পাখি সুন্দরবন থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
এক গষেণায় বলা হয়েছে, কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে প্রতি বছরে ৭৯ লক্ষ টন কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসৃত হবে যার ফলে শুধু সুন্দরবন নয় সমস্ত বাংলাদেশে কার্বন নিঃসরণ হার অনেক বৃদ্ধি পাবে যা পরিবেশের ধ্বংসের কারণ। কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বছরে ৪৭ লক্ষ ২০ হাজার টন কয়লা পুড়িয়ে ৭ লক্ষ ৫০ হাজার টন বিষাক্ত ছাই উৎপন্ন হবে। এই ছাই ব্যাপক মাত্রায় পরিবেশ দূষিত করবে। কারণ এতে আর্সেনিক, পারদ, সীসা, নিকেল, ভ্যানাভিয়াম, ব্যারিয়াম, বেরিলিয়াম, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম, সেলেনিয়াম, রেডিয়াম মিশে থাকে। সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হলো এ বিষাক্ত ছাই দিয়ে প্রকল্প এলাকার ১৮৩৪ এর জমির ১৪১৪ একর জমি ভরাট করা হবে। যার ফলে বৃষ্টির পানির সাথে ছাইয়ের বিষাক্ত পদার্থগুলি নদীতে মিশবে এবং এর থেকে সমস্ত সুন্দরবনে ছড়িয়ে পড়বে। আর এর আবশ্যক পরিণাম হচ্ছে সুন্দরবনের ধ্বংস। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে নিঃসৃত বিষাক্ত পদার্থের ফলে মারাত্মক স্বাস্থ্যহানি এবং রোগব্যাধির সংক্রামণ ঘটবে। যেমন : নিউমোনিয়া ইত্যাদি। আবার তেজস্ক্রিয়তার ফলে ক্যান্সারের মতো মরণব্যাধিও হতে পারে। রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য প্রতি বছর ৪৭ লক্ষ ২০ হাজার টন কয়লা অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানি করতে হবে যার ফলে সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে বছরের ৫৯ দিন বড় জাহাজ এবং ২৩৬ দিন ছোট জাহাজ চলাচল করবে দিনে এবং রাতে। এর ফলে যেমনি হবে শব্দ দূষণ, পানি দূষণ তেমনি সমস্যা হবে সমস্ত জীবকূলেরও।
বাংলাদেশে উপকূল অঞ্চলের দৈর্ঘ্য ৭১০ কিলোমিটার। এর মধ্যে সুন্দরবন ১২৫ কিলোমিটার। টেকনাফের মোহনা থেকে সাতক্ষীরা জেলার সীমান্ত নদী রায়মঙ্গল কালন্দি পর্যন্ত খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের ১৪টি উপকূলীয় জেলায় বিস্তৃত। দেশের ২৫ শতাংশ জনগণ উপকূল এলাকায় বসবাস করে, তেমনি জাতীয় অর্থনীতিতে জিডিপির কমবেশি প্রায় ২৫ শতাংশ অবদান এ অঞ্চলেরই। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার সত্ত্বেও এ অঞ্চল, এর অবকাঠমো এবং বসবাসকারী জনগণের অর্থনৈতিক জীবন নানা দৈবদুর্বিপাক, বৈষম্য ও অবহেলা আর অমনোযোগিতার শিকার। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের প্রায় ১০ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা এই সুন্দরবন কেন্দ্রীক। দেশের গোটা দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চলের প্রায় আড়াই কোটি মানুষের বসত বাড়ির ছাউনি’র যোগান দিত সুন্দরবনের গোলাপাতা। প্রায় ৫০ লাখ মানুষ সুন্দরবন ও আশেপাশের খাল-নালা ও নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতো। কিন্তু এখন তা আর নেই।
মাত্র দুই থেকে তিন বছর আগেও সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা জনপদের মানুষের ঘুম ভাঙতো পাখির কলতানে। বর্তমানে সে সব পাখির ডাক এখন আর শুনতে পান না তারা। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে কোন ধারণা না থাকলেও স্থানীয় মানুষ বুঝতে পারে বন আর আগের অবস্থানে নেই।
তাদের কয়েকজন জানান, বিভিন্ন প্রজাতির গাছ এখন আর আগের মতো জন্মায় না, হারিয়ে গেছে কিছু প্রজাতির পাখিও। এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মৎস্যসমৃদ্ধ সুন্দরবনের নদী-খালে মাছের প্রাচুর্র্য হ্রাস পেয়েছে। বনের অসংখ্য পশুপাখির জীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছে। বনের গাছে গাছে অগণিত বানর এখন আর নজরে আসে না। বাঘের অভয়ারণ্য আর হরিণের বিচরণ ক্ষেত্র- দুই হ্রাস পেয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষের পাশাপাশি বারবার প্রকৃতির আঘাত সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্যকে ব্যাহত করছে। একটির অনুপস্থিতি অপর জীবের অস্তিত্বকে সঙ্কটাপন্ন করে তুলছে।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে সুন্দরবন ও উপকূল রক্ষায় কাজ করছে সরকার। দুর্যোগের ঝুঁকি কমাতে বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের সুরক্ষা, টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণসহ বিভিন্ন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে ধনী দেশগুলোর কাছ থেকে জলবায়ু ক্ষতিপূরণ আদায়ে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। চলতি সপ্তাহে সাতক্ষীরায় ‘দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি ও করণীয়’ শীর্ষক সংলাপে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি এসব কথা বলেন।

Please follow and like us:

Check Also

দীর্ঘ খরতার পর সাতক্ষীরায় শীতল বৃষ্টিতে স্বস্তির পরশ

অবশেষে অগ্নিস্নানের পর ধরণীতে নেমে এলো স্বস্তির বৃষ্টি। দীর্ঘদিন খরতায় পুড়ে শীতল বৃষ্টিতে ভিজলো মাটি। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।