পর্যটনে সম্ভাবনাময় মান্দারবাড়িয়া

সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলায় বঙ্গোপসাগরের তীর ধরে জেগে ওঠা এক নয়নাভিরাম সমুদ্র সৈকত মান্দারবাড়িয়া। যার একপাশে পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনভূমি ‘সুন্দরবন’, অপর পাশে বঙ্গোপসাগরের অতল, অবিশ্রান্ত জলরাশির খেলা। প্রকৃতির নিবিড় ছোঁয়ায় বেড়ে ওঠা ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এই বেলাভূমি এখনো যেন অনেকটাই থেকে গেছে অনাবিষ্কৃত। দুর্গম যোগাযোগব্যবস্থা, অবকাঠামোগত উন্নয়নের ঘাটতি, সরকারি প্রচার-প্রসারের উদ্যোগহীনতা ইত্যাদি নানাবিধ কারণে দীর্ঘদিনেও সেভাবে জনসম্মুখে আসেনি দৃষ্টিনন্দন দীর্ঘ এই সমুদ্রসৈকতটি। মান্দারবাড়িয়া সমুদ্রসৈকত একদিকে যেমন হয়ে উঠতে পারে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে অবহেলিত উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের ভাগ্যবদলের হাতিয়ার, অন্যদিকে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে রাখতে পারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। দেশের পর্যটনশিল্পকে সমৃদ্ধ করার সব ধরনের উপকরণ বিদ্যমান অবহেলায়, অব্যবস্থাপনায় পড়ে থাকা অপরূপ সৌন্দর্যের এই লীলাভূমিটিতে। একই সঙ্গে বনভূমি এবং জলাভূমির সহাবস্থান যেন এই সমুদ্রতটটিকে দিয়েছে সৌন্দর্যের অনন্য এক উচ্চতা; যা সহজেই যে কোনো পর্যটককে বিমোহিত করতে সক্ষম। শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের নীলডুমুর ঘাট থেকে এর দূরত্ব ৭৫ কিলোমিটার। যাত্রা পথের প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং একপ্রান্তে সুন্দরবনের গা ছমছমে ভয়ংকর পরিবেশ যে কোনো ভ্রমণপিপাসু মানুষকে দিতে পারে ভ্রমণের সর্বোচ্চ আনন্দ। দেখা যাবে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত। সাগরের দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি এবং জঙ্গলের গাছগাছালির সবুজ বেষ্টনী মিলেমিশে তৈরি করেছে যেন এক রূপকথার রাজ্য। যে কোনো প্রকৃতিপ্রেমী ভ্রমণপিপাসু ব্যক্তিই চাইবে এমন এক রাজ্যে হারিয়ে যেতে।

বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পের মূল উপাদান এ দেশের প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পদ। আর এই শিল্পকে সমৃদ্ধ করতে প্রয়োজন এসব উপাদানগুলোকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো। দেশের পর্যটনশিল্পকে আরো সমৃদ্ধশালী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে মান্দারবাড়িয়া। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, বিশ্বব্যাপী উপকূলীয় পর্যটন, পর্যটন বাজারের বৃহত্তম অংশ সারা বিশ্বের জিডিপির ৫ শতাংশ এবং মোট কর্মসংস্থানের ৬-৭ শতাংশ। ১৫০টি দেশে এটি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী প্রথম পাঁচটি খাতের মধ্যে একটি; যা মান্দারবাড়িয়ার অপার সম্ভাবনাকে ইঙ্গিত দেয়। যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে মান্দারবাড়িয়াকে একটি পূর্ণাঙ্গ উপকূলীয় পর্যটনকেন্দ্রে রূপ দিয়ে টেকসই পর্যটন সৃষ্টি করতে পারলে সেটি যেমন কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্য দূর করতে সক্ষম হবে, একইভাবে দেশের অর্থনৈতিক খাতেও সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারবে। দেশের অন্যান্য উপকূলীয় পর্যটনকেন্দ্রগুলো থেকে যে পরিমাণ আয় হয়, সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে মান্দারবাড়িয়া থেকেও একই পরিমাণ আয় সম্ভব। এছাড়া উপকূল ঘিরে মেরিন ড্রাইভ নির্মাণ এবং পায়রা বন্দরের সঙ্গে সারসরি সংযোগ সড়ক সৃষ্টির মতো পরিকল্পনা দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের যোগাযোগব্যবস্থা অনেক বেশি সহজ করে তুলবে; যা দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির এক নতুন দ্বার উন্মোচন করতে সক্ষম। বর্তমান বিশ্বের বহুল আলোচিত ‘ব্লু-ইকোনমি’ বা সুনীল অর্থনীতির অন্যতম ক্ষেত্র হতে পারে মান্দারবাড়িয়া সমুদ্রসৈকত। মান্দারবাড়িয়াকে টেকসই পর্যটনকেন্দ্র সৃষ্টির মাধ্যমে সারা বছর পানিবন্দি থাকা দক্ষিণাঞ্চলীয় উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মান ঊর্ধ্বগামী করা সম্ভব। প্রচুর কর্মসংস্থানের মাধ্যমে এ অঞ্চলের বেকারত্ব দূরীকরণ করাও সম্ভব হবে। সৈকতভিত্তিক বিনোদন এবং পর্যটন, সমুদ্রের কাছে পর্যটন কার্যক্রম, ইয়টিং, মেরিনাসহ নটিকাল বোটিংয়ের মাধ্যমে একদিকে যেমন মান্দারবাড়িয়ার প্রসার বাড়ানো সম্ভব তেমনিভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন দ্রুতগামী হবে। সৃষ্টি হবে ‘কমিউনিটি বেজড ট্যুরিজমের’; যা হবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নের এক নতুন সূচনা।

যোগাযোগব্যবস্থার অপ্রতুলতা মান্দারবাড়িয়া সমুদ্রসৈকতের দৃষ্টির অগোচরে পড়ে থাকার অন্যতম প্রধান কারণ। রাজধানী থেকে সাতক্ষীরা সরাসরি সংযোগ থাকলেও সাতক্ষীরা সদর থেকে মান্দারবাড়িয়া যাওয়ার নেই কোনো সরাসরি সড়ক ব্যবস্থা। ভাঙা ভাঙা পথ পাড়ি দিতে পোহাতে হয় অনেক ভোগান্তি। নৌপথে নেই অত্যাধুনিক কোনো নৌযান। যার কারণে যে কোনো সময় দুর্ঘটনার ঝুঁকি থেকে যায়। এছাড়া স্থায়ী বাঁধ না থাকার কারণে প্রায় সারা বছরই উপকূলীয় এলাকা থাকে পানিবন্দি; যার ফলে যাত্রাপথ হয়ে ওঠে আরো দুর্গম। রয়েছে নিরাপত্তাব্যবস্থারও ঘাটতি। এসব কারণে সবধরনের সৌন্দর্য্য থাকা সত্ত্বেও পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হচ্ছে মান্দারবাড়িয়া। এছাড়া প্রয়োজনীয় সামগ্রীর অপ্রতুলতা, হোটেল, মোটেল ইত্যাদি আশ্রয়স্থলের অভাব মান্দারবাড়িয়ার অপার সম্ভাবনাকে ধীরে ধীরে কমিয়ে আনছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি, উপকূলে প্রয়োজনীয় বাঁধ নির্মাণ, নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার, অত্যাধুনিক নৌযান চালু, প্রয়োজনীয় হোটেল, রিসোর্ট স্থাপন ইত্যাদি উদ্যোগ মান্দারবাড়িয়াকে একটি টেকসই উপকূলীয় পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত করতে পারে। এছাড়া সরকারি বিনিয়োগের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাগুলোকেও বিনিয়োগের সুযোগ প্রদান এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। মান্দারবাড়িয়াতে নেই সৌন্দর্যের কোনো অভাব। অভাব আছে শুধু পরিকল্পিত উদ্যোগ, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও আন্তরিক প্রচেষ্টার। এখানকার বিদ্যমান সমস্যার সমাধান করতে পারলে এবং উপযুক্ত পর্যটনবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারলে মান্দারবাড়িয়া হয়ে উঠবে কর্মসংস্থান, বিনিয়োগ ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম প্রধান উত্স।

Please follow and like us:

Check Also

২৮শে এপ্রিল খুলছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শনিবারেও ক্লাসের পরিকল্পনা

আগামী ২৮শে এপ্রিল থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার জন্য সব রকমের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।