আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরাঃ গত ১৫ বছরে বাংলাদেশে আম চাষে ঘটে গেছে এক বিস্ময়কর বিপ্লব। উৎপাদন বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ। আম উৎপাদন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে মাথাপিছু বার্ষিক ভোগের পরিমাণ। স্বাদে, গন্ধে ও পুষ্টিগুণে আম অতুলনীয়। বিশেষ করে সাতক্ষীরার আম পাকা শুরু করে সবার আগে। তাই এখানকার আমের চাহিদা থাকে একটু বেশি। আশানুরূপ ফলন হলে ২২৫ কোটি টাকার আম বিক্রির কথা জানিয়েছে কৃষি বিভাগ। এবার জেলার চার হাজার ১১৫ হেক্টর জমিতে চাষ হওয়া আমের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৫ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন। জেলার হাট বাজার আমে ভরে উঠেছে। প্রতিদিন এ জেলা থেকে ১৫-২০ ট্রাকা আম দেশের বিভিন্ন জেলাতে বেচা কেনা হচ্ছে। দেশের ফল থেকে আসা পুষ্টি চাহিদার একটা বড় অংশের জোগান দেয় এই আম। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাবে গত ২০ বছরে বাংলাদেশে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি হারে আমের চাষ বেড়েছে। বছরে ১৬ শতাংশ হারে ফলটির উৎপাদন বাড়ায় মাথাপিছু ভোগের পরিমাণ ১০ বছরে দ্বিগুণ হয়েছে। আমের নতুন নতুন উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন, সারা দেশে চাষ সম্প্রসারণ, কৃষকের অক্লান্ত পরিশ্রম ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যহারের কারণে ২০১৮ সাল থেকে বাংলাদেশ আম উৎপাদনে সপ্তম স্থানে উঠে আসে। তবে আম উৎপাদনের সঠিক চিত্র প্রকাশিত হলে বাংলাদেশ আম উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে পঞ্চম স্থানে উঠে আসবে। দেশে ও বিদেশে প্রতি বছর এ দেশের সুস্বাদু আমের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পৃথিবীর ২৩টি দেশে বাংলাদেশের আম রপ্তানি হচ্ছে।
অর্থনৈতিক দিক থেকে আমের অবদান কোনো অংশে কম নয়, আন্তর্জাতিক মানের এই ফলটি শুধু পুষ্টি ও স্বাদের জন্যই বিখ্যাত নয়, এটি বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াতে পারে। ইতোমধ্যে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে ফিলিপাইন ও ভারতে। ফিলিপাইন ‘স্পার্জিং’ পদ্ধতিতে বছরের অধিকাংশ সময় আম উৎপাদন করে এবং নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করে থাকে। ভারতও একইভাবে আমি রপ্তানি করে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের অবস্থা উল্টো। এত সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত আমকে অর্থনৈতিকভাবে কাজে লাগাতে পারিনি।
আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশি আমের ব্র্যান্ডিং ইমেজ সৃষ্টি না হওয়ায় আম রপ্তানির উজ্জ্বল সম্ভাবনার সূফল পাচ্ছে না আম চাষিরা। এছাড়া উৎপাদিত আমের সেলফ লাইফ কম থাকা, কৃষির উত্তম চর্চার অভাব, রপ্তানিযোগ্য উচ্চমূল্যের জাতের অপর্যাপ্ততা, নজরদারি, নিরাপদ ও আন্তর্জাতিক গুণগত মানসম্পন্ন আমের জাত নির্বাচন ও উৎপাদনে ঘাটতি, নতুন বাজার যাচাই ও সৃৃষ্টিতে উদ্যোগ গ্রহণে সমন্বয়ের অভাবে কাঙ্খিত সফলতা পাচ্ছে না দেশের আমের বাজার। বাংলাদেশ আম উৎপাদনে বিশ্বে সপ্তম হলেও, পণ্যটি রপ্তানি আয়ের দিক থেকে একদমই তলানিতে ছিল। বাংলাদেশের চেয়েও কম পরিমাণ আম উৎপাদন করে অনেক দেশ রপ্তানি থেকে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে। সরকারি হিসেবে গত বছর বাংলাদেশের আমের উৎপাদন ছিল ১৪ লাখ মেট্রিক টন। যা বিশ্ব উৎপাদনের দুই দশমিক ছয় ভাগ। সপ্তম উৎপানকারী দেশ হয়েছেও বাংলাদেশ মাত্র পাঁচ লাখ মার্কিন ডলারের আম রপ্তানির সুযোগ পেয়েছে। বিশেজ্ঞরা বলছে, দেশে বছরে প্রায় ১৫ লাখ টন আম উৎপাদিত হয়, যার বাজারমূল্য প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু সে তুলনায় রপ্তানি অতি নগণ্য।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, দেশের প্রধান আম উৎপাদনকারী জেলাগুলো হলো- সাতক্ষীরা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর, রংপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, যশোর, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান। দেখা যায়, সাতক্ষীরা জেলায় আম বাজারে প্রথম আসে এবং দেশের বিভিন্ন জেলায় সেগুলো বাজারজাত করা হয়। মৌসুমের শুরুতে আমের চাহিদাও বেশি থাকে, ফলে ভালো দামে কেনা-বেচা হয়। ডেনমার্ক ও জার্মানির পর এবার সাতক্ষীরার গোবিন্দভোগ আম যাচ্ছে হংকংয়ে। গত এক দশক ধরে সাতক্ষীরার হিমসাগর, ল্যাংড়া রপ্তানি হয়ে আসছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে।
বিশেজ্ঞরা বলছে, এদেশের মাটি, জলবায়ু ও ভৌগলিক অবস্থান উপযোগী হওয়ায় এবং শ্রমিকের সহজলভ্যতা থাকায় গুণগতভাবে উৎকৃষ্ট আম উৎপাদন সম্ভব। আন্তর্জাতিক বাজারে আমের স্থায়ী রপ্তানি বাজার রয়েছে এবং এথনিক ও নিচি মার্কেটের সুবিধাও রয়েছে। বিধায় বর্তমানে বিদেশে আম রপ্তানির উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। এ লক্ষ্যে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিশেষ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, আমদানি রপ্তানি ব্যুরো এবং হর্টেক্স ফাউন্ডেশনকে সক্রিয় হতে হবে। এছাড়া আম রপ্তানির জন্য বিদেশে বাংলাদেশী দূতাবাসগুলোর মাধ্যমে বাজার অনুসন্ধান করা;বাংলাদেশে অবস্থানকারী বিদেশি দূতাবাসের কর্মকর্তাদের আমের মৌসুমে আম উৎপাদনকারী জেলাগুলো পরিদর্শন করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা; বিদেশি বিনিয়োগকারীদের দেশে আমন্ত্রণ জানিয়ে দেশীয় আম বাগান পরিদর্শন করানো; আম রপ্তানি করার জন্য প্যাকেজিং সামগ্রির ওপর ভর্তুকি প্রদান করা; এবং আম রপ্তানির জন্য একটি কার্যকর নীতিমালা বাস্তবায়ন দরকার। আমের রপ্তানি বাড়াতে সর্বাত্মক উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, ‘দেশের আমকে আমরা ব্যাপকভাবে বিশ্ববাজারে নিয়ে যেতে চাই। সে জন্য রপ্তানি বাধাগুলো চিহ্নিত করে তা নিরসনে কাজ চলছে।
এ বছর আমের মুকুল ভালো হওয়ায় ও আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় অন্য যেকান বছরের তুলনায় জেলাতে আমের অধিক ফলনের আশা করছেন সাতক্ষীরার বাগান মালিক ও চাষিরা। বড় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রফতানিও করা যাবে। এ বছর নবমবারের মতো ইংল্যান্ড ও ইউরোপের কয়েকটি দেশে যাবে এই জেলার আম। জেলা প্রশাসনের বেধে দেওয়া সমানুযায়ী ৫ মে গোপালভোগ, গোবিন্দভোগ, বোম্বাই, গোপালখাস, বৈশাখীসহ স্থানীয় জাতের আম,২৫ মে হিমসাগর, ১ জুন ল্যাংড়া এবং ১৫ জুন আ¤্রপালি আম সংগ্রহের দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। জেলা কৃষি বিভাগ জানায়, চলতি মৌসুমে জেলার চার হাজার ১১৫ হেক্টর জমিতে আম চাষ করেছেন ১৩ হাজার ১০০ জন চাষি। এর মধ্যে সদর উপজেলায় এক হাজার ২৩৫ হেক্টর, কলারোয়ায় ৬৫৫ হেক্টর, তালায় ৭১৫ হেক্টর, দেবহাটায় ৩৭০ হেক্টর, কালিগঞ্জে ৮৩৫ হেক্টর, আশাশুনিতে ১৪৫ হেক্টর ও শ্যামনগরের ১৬০ হেক্টর জমিতে আম চাষ করা হয়েছে। চলতি মৌসুমে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৫ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন আম।
গতকাল ১৯ মে শুক্রুবার সাতক্ষীরার সুলতানপুর বড়বাজার ঘুরে আমের বিচিত্র সাইজ ও দামের দামের তারতম্য পরিলক্ষিত হয়। চেহারা সুন্দর ও আকারে বড় আম বিক্রি হচ্ছে মণ প্রতি ২২শ থেকে ২৪শ টাকায়। এছাড়া ১৮শ থেকে ২ হাজার, ১৪শ থেকে ১৬শ টাকা এবং ছোট আকারের আম ১হাজার থেকে ১২শ টাকায় মণ বিক্রি হচ্ছে।
সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মনির হোসেন বলেন,‘‘আমের বাম্পার ফলন হয়েছে। সাতক্ষীরার আম বিদেশে রপ্তানির ক্ষেত্রে এ বছর ২০০ মেট্রিকটন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। নির্ধারিত সময়ে আম সংগ্রহ করা হলে বিদেশে বরাবরের মতো সুনাম ধরে রাখা সম্ভব হবে।’’
![](https://crimebarta.com/wp-content/uploads/2023/05/0-3-660x330.jpg)