মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা : আরো কঠিন পদক্ষেপের আশঙ্কা বদলে যাচ্ছে রাজনৈতিক পরিস্থিতি

॥ ফারাহ মাসুম ॥
যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞার নতুন পদক্ষেপ বাংলাদেশের জন্য একটি নির্বাচন গেম চেঞ্জার হয়ে দাঁড়াতে পারে। এটি একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের সম্ভাবনাকে আরো বাড়িয়ে তুলতে পারে। নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা হলে আরো কঠোর পদক্ষেপের আভাস দেয়া হচ্ছে। নিষেধাজ্ঞা জারির পর গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ব্যাপারে প্রত্যাশিত হস্তক্ষেপ দেখা যায়নি। জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনে সহায়তা দেয়ার আবেদন নিয়ে যাওয়া ৪ প্রতিনিধিকে আটক করার পরও ছেড়ে দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নিজে বলেছেন, তিনি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সংকটের সমাধান চান। এ ধরনের সুর ভিসা নিষেধাজ্ঞা জারির কদিন আগেও শোনা যায়নি। তবে এটি ঠিক যে, একটি নীতি গ্রহণই চূড়ান্ত কথা হয় না। তার বাস্তবায়নের ওপর নির্ভর করে এর সুফল কতটা অবাধ, মুক্ত ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য পাওয়া যাবে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেয়ার পর পাল্টা পক্ষও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। চীনের ভাইস মিনিস্টার বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তিনি চীন সফরের আমন্ত্রণ করে গেছেন। আগামী সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরেও যাবার কথা। সাধারণভাবে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, বেইজিং যেকোনোভাবেই সরকারকে ক্ষমতায় থেকে যেতে সমর্থন দিতে প্রস্তুত। দেশটি এ ব্যাপারে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সব ধরনের সহায়তা দিতে আশ্বস্ত করেছে বলে জানা গেছে। অন্যদিকে প্রতিবেশী ভারত প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখার জন্য সমর্থন দেয়ার খবর না এলেও সরকারি দলের নীতিপ্রণেতারা বিশ্বাস করেন যে, প্রতিবেশী দেশটি তাদের পক্ষে রয়েছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একটি সমঝোতায় আসার ব্যাপারেও তারা সহায়তা করছে। যদিও এতে তেমন কোনো ফল এখনো দেখা যাচ্ছে না। অধিকন্তু যুক্তরাষ্ট্র মুক্ত, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যাপারে কোনো আপস না করা বার্তাই দিচ্ছে।
আওয়ামী লীগ যেকোনোভাবেই ক্ষমতায় থেকে যেতে চাইছে, এ বিষয়ে এখন রাখঢাক নেই। ডেভিড বার্গম্যানের মতে, আওয়ামী লীগ নিজেকে দেশের একমাত্র বৈধ শাসক দল হিসেবে দেখে এবং নিশ্চিত হতে চায় যে, তারা নির্বাচনে জয়ী হবেই। দলটি চাইছে নিশ্চিতভাবে ২০১৮ সালের মতো পদ্ধতিগতভাবে ভোট কারচুপি না করে জয় নিশ্চিত হবার মতো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে। তার পর্যবেক্ষণ হলো, কিছু দেশে শাসক দল অবৈধ উপায়ে নির্বাচনে জয়লাভ করতে চাইলেও রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো পাল্টা ভারসাম্য হিসেবে কাজ করতে সক্ষম, কিন্তু বাংলাদেশে তা হয় না। গণমাধ্যম, বিচার বিভাগ, পুলিশ, নির্বাচন কমিশনসহ সব প্রতিষ্ঠানই কার্যকরভাবে আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আর তাই নির্বাচনে চুরি ঠেকাতে দেশের অভ্যন্তরে তেমন কিছু করা সম্ভব হয় না। তার মতে, বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন গণতান্ত্রিক পশ্চিমের চাপের ওপর নির্ভর করবে।
সাম্প্রতিক মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের নতুন ভিসানীতি বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনে সহায়তার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে বলে মন্তব্য করে বার্গম্যান বলেন, এ নীতির অধীনে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করার জন্য দায়ী বা জড়িত বলে মনে করা যেকোনো বাংলাদেশি ব্যক্তির জন্য ভিসা প্রদান সীমিত করতে পারবে। এর মধ্যে বর্তমান এবং সাবেক বাংলাদেশি কর্মকর্তা, সরকার সমর্থক ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার বিভাগ এবং নিরাপত্তা পরিষেবার সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করা’ কেবলমাত্র প্রতিদিনের কারচুপির বিষয় নয়, এর মধ্যে রয়েছে ব্যাপক গণতান্ত্রিক অনুশীলনের একটি বিস্তৃত তালিকাÑ যার মধ্যে রয়েছে ভোটারভীতি প্রদর্শন, সহিংসতার ব্যবহার, জনগণকে তাদের সংগঠনের স্বাধীনতা এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার প্রয়োগ করা থেকে বিরত রাখতে এবং রাজনৈতিক দল, ভোটার, সুশীল সমাজ বা মিডিয়াকে তাদের মতামত প্রচার করা থেকে বিরত রাখার জন্য পরিকল্পিত ব্যবস্থার ব্যবহার।
পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, নিঃসন্দেহে এটি এমন একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ, যা শুধু সরকারের পক্ষেই নয়, বিরোধীদলগুলোর জন্যও কিছু বার্তা নিয়ে আসে। স্পষ্টতই এ ধরনের নীতির অধীন হওয়া বাংলাদেশ সরকারের জন্য বিব্রতকর। কারণ এটি স্পষ্টভাবে দেখায়, মার্কিন সরকার মনে করে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করা আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে কঠিন। প্রধানমন্ত্রী নিজে জোরালোভাবে বলেন, তিনি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে, কিন্তু তার কাজের সাথে এর মিল খুঁজে পাওয়া কঠিন।
জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের পার্টনারশিপ ডায়ালগের সময় এ ভিসা নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি অবহিত করা হয়। এরপর ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানান যে, মার্কিন সরকারের কর্মকর্তারা নতুন নীতি সম্পর্কে অবহিত করার পরে মনে হয়েছে, দেশটির সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের ঘোষণা এবং পরবর্তী পদক্ষেপ আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের শক্তিকে গুরুতরভাবে ক্ষুণ্ন করতে পারে। রাষ্ট্রদূত তার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহকর্মীদের কাছে লিখেছেন, মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তারা তাকে বলেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের সরকার বাংলাদেশে আসন্ন নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতিকে সমর্থন করার জন্য এ নীতি গ্রহণ করছে। ভিসা নিষেধাজ্ঞা নীতিটি ঘোষণার পর গত ২৫ মে বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সমুন্নত রাখার জন্য সকল স্তরে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তার সরকারের দ্ব্যর্থহীন অঙ্গীকারের বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ নিষেধাজ্ঞাগুলোকে দেখতে চায়।
যেকোনো নীতির মতোই, নতুন মার্কিন ভিসা ব্যবস্থার চূড়ান্ত সাফল্য নির্ভর করবে বাস্তবায়নের ওপর। যারা নতুন নীতি বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছেন, তাদের জন্য প্রথম চ্যালেঞ্জ হলো ভিসা সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত জানানোর জন্য পর্যাপ্ত প্রমাণ সংগ্রহ করতে মার্কিন সরকারের ক্ষমতার সাথে সম্পর্কিত। মার্কিন দূতাবাসের মুষ্টিমেয় কর্মীদের জন্য নির্বাচনের দৌড়ে রাজনৈতিক সহিংসতা এবং ভয় দেখানোর ঘটনা তদন্ত ও মূল্যায়ন করা একটি কঠিন কাজ হবে। সারা দেশে ভ্রমণের চ্যালেঞ্জ, নিরাপত্তার বিবেচনা, ভাষার প্রতিবন্ধকতা এবং জড়িত লোকের সংখ্যা এ কাজকে জটিল করে তুলবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদনের মতো শেষ পর্যন্ত আমেরিকান কর্মকর্তাদের ভিসার সিদ্ধান্ত সমর্থন করার জন্য প্রমাণ সংগ্রহে সহায়তা করার জন্য নাগরিক সমাজের কর্মী, সাংবাদিক এবং মানবাধিকার রক্ষাকারীদের একটি নেটওয়ার্কের ওপর নির্ভর করতে হবে।
পর্যবেক্ষকদের মতে, এ নীতির সাফল্যের প্রকৃত পরীক্ষা হলোÑ এটি বৃহত্তর রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং একটি ভালো নির্বাচনী পরিবেশ প্রচারের প্রচেষ্টায় অবদান রাখে কিনা। ক্ষমতা বজায় রাখার জন্য যারা সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করেছেন, তাদের জন্য শুধুমাত্র মার্কিন ভিসা প্রত্যাহার হওয়ার সম্ভাবনা পথ পরিবর্তন করার জন্য যথেষ্ট হবে না। তবুও নিষেধাজ্ঞার হুমকি বাস্তব এবং তাৎক্ষণিক পরিবারের সদস্যদের ওপর সম্ভাব্য প্রভাবের কারণে জটিল হবে, যারা তাদের ভ্রমণের বিকল্পগুলো সীমিত দেখতে পাবে। এটি আরও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠবে যদি যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ইইউর সদস্য দেশের মতো অন্যান্য সমমনা দেশ এটি অনুসরণ করে।
পর্যবেক্ষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের এ নীতিতে যাদের সবচেয়ে বেশি হারাতে হবে, তাদের মধ্যে নিরাপত্তা বাহিনী, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, সিভিল সার্ভিস এবং ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বতন স্তর অন্তর্ভুক্ত থাকবে যারা তাদের এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের বিদেশ ভ্রমণে অক্ষম দেখতে চাইবে না। সরকার ও বিরোধীদলের শীর্ষস্থানীয়দের সমর্থনকারী স্তম্ভগুলো যদি দুর্বল হতে শুরু করে, তাহলে প্রকৃত পরিবর্তনের সম্ভাবনাও একইভাবে বৃদ্ধি পাবে।
২০২১ সালের ডিসেম্বরে দেশের র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) এবং এর কর্মকর্তাদের ওপর মার্কিন ম্যাগনিটস্কি নিষেধাজ্ঞার ফলে নিঃসন্দেহে গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড অনেকখানি^ হ্রাস পায়। তখন আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ এবং রাজনীতিবিদরা ক্ষমতার এ অপব্যবহারের বিষয়ে দুবার চিন্তা করেছিলেন। নতুন নিষেধাজ্ঞার হুমকি আর্থিক সম্পদের ওপর প্রভাব না ফেললেও বাংলাদেশে একটি কার্যকর লিভার হিসেবে কাজ করতে পারে।
নিষেধাজ্ঞার নতুন হুমকি কীভাবে প্রাক-নির্বাচন পরিবেশে বেশ তাৎক্ষণিক প্রভাব ফেলতে পারে, তা দেখা যাচ্ছে। আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ বিরোধীদলগুলোকে বিক্ষোভ ও সমাবেশ করা থেকে বিরত রাখতে আগ্রহী হচ্ছে না। এটি সাম্প্রতিক অতীতে নিয়মিত করা হয়েছে। এর ফলে এটি নিশ্চিত যে, এ নতুন নীতিটি নির্বাচনী গেম চেঞ্জার হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। যদি অন্যান্য দেশও একইভাবে ডিজাইন করা তাদের নিজস্ব আইন ব্যবস্থার মধ্যে অনুমোদন নীতি নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে।
বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও ভারসাম্যের জন্য নতুন মার্কিন ভিসানীতি একটি স্বাগত পদক্ষেপ হবে। এটিও তাৎপর্যপূর্ণ যে বাইডেন প্রশাসন নয়াদিল্লির সম্ভাব্য প্রতিবাদ সত্ত্বেও তার নতুন নীতি নিয়ে এগিয়েছে। অতীতে ভারত তার প্রতিবেশী ইস্যুতে নয়াদিল্লির প্রতি ওয়াশিংটনের সম্মানের কারণে বাংলাদেশে মার্কিন নীতির ওপর ভার্চুয়াল ভেটো প্রয়োগ করেছিল। এখন বাইডেন প্রশাসন ভারতের সাথে সম্পর্ক জোরদার করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভারতের মতামতকে সেভাবে গুরুত্ব না দেয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে।
এদিকে জাতিসংঘের বিশেষ র‌্যাপোর্টিয়ার অলিভিয়ের ডি শ্যুটার গত ২৩ মে মঙ্গলবার বাংলাদেশ সরকারের কাছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন স্থগিত রাখার সুপারিশ করেছে। তিনি উল্লেখ করেন, স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার চর্চা করার কারণে সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, বিরোধী রাজনীতিবিদ এবং শিক্ষাবিদদের এ আইনের আওতায় আটক করা হয়েছে। যারা মানবাধিকারের জন্য লড়াই করেন, তারা ভয়-আতঙ্কের মধ্যে থাকবেনÑ এটি কোনোভাবেই স্বাভাবিক নয় বলে উল্লেখ করেন অলিভিয়ের ডি শ্যুটার। যতক্ষণ পর্যন্ত এ আইনের উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত আইনটি স্থগিত রাখতে সুপারিশ করেন তিনি।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এ পর্যন্ত ২ হাজার ৪০০-এর বেশি মানুষকে অভিযুক্ত করা হয়েছে উল্লেখ করে ডি শ্যুটার বলেন, এ আইনে করা মামলায় অনেকে দীর্ঘসময় আটকে ছিলেন। এসব বিষয় দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করবে এবং বাংলাদেশ যে বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে চাইছে, তাদেরও শঙ্কিত করবে।
এদিকে ভিসা নিষেধাজ্ঞার পর আরো নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে বলে নানা সূত্র থেকে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ৬ বিশিষ্ট কংগ্রেসম্যান সম্প্রতি দেশটির প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছে এক চিঠি লিখেছেন। ওই চিঠিতে তারা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ করার জন্য এবং এ শরৎকালে নির্ধারিত অবাধ ও সুষ্ঠু সংসদ নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশের জনগণকে সম্ভাব্য সর্বোত্তম সুযোগ দেওয়ার জন্য জরুরি পদক্ষেপের অনুরোধ জানান।
তারা বলেন, ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে শেখ হাসিনার সরকার কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘনের শত শত উদাহরণ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, ফ্রিডম হাউস; এমনকি জাতিসংঘের রিপোর্টসহ বিভিন্ন এনজিও নথিভুক্ত করেছে, যা হাসিনা সরকারের প্রকৃত স্বরূপকে প্রদর্শন করে। এ সরকার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ক্রমবর্ধমানভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে, নাগরিকদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার ব্যাপক অপব্যবহার করেছে, নির্যাতন করেছে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, জেলে নিয়ে গেছে বিরোধীদের এবং শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকারীদের লাঞ্ছিত বা হত্যা করেছে।
মার্কিন ৬ কংগ্রেসম্যান বলেন, সাম্প্রতিক মাসগুলোয় হাজার হাজার শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারী সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের জন্য বিক্ষোভ করেছে, যা হাসিনা সরকারের পরিবর্তনের জন্য জনগণের একমাত্র আশা। এর প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) বাংলাদেশে নির্যাতন, গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের প্রধান অপরাধী, শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের গ্রেপ্তার, ভয়ভীতি; এমনকি হত্যা করেছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ অসংখ্য এনজিও দ্বারা র‌্যাবকে একটি সরকারি ‘ডেথ স্কোয়াড’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। জার্মানির রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারকারী ডিডব্লিউ এবং সুইডেনভিত্তিক সংবাদ সংস্থা নেত্রা নিউজের সাম্প্রতিক তদন্তে দুই হুইসেলব্লোয়ার এবং র‌্যাবের সাবেক সদস্য স্বীকার করেছেন যে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও বলপূর্বক গুমের এসব ঘটনা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুমোদন ছাড়া সম্ভব ছিল না।
আমেরিকান কংগ্রেসম্যানরা বলেন, মার্কিন সরকার এক বছরেরও বেশি সময় আগে র‌্যাবকে ‘গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী’ হিসেবে মনোনীত করেছে এবং অনেক হত্যাকাণ্ড ও অন্যান্য নৃশংসতার জন্য দায়ী একাধিক আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষকে অনুমোদন দিয়েছে। তথাপি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার পর থেকে হাসিনা সরকার কেবলমাত্র বাংলাদেশের জনগণের ওপর তার পদ্ধতিগত দমন-পীড়ন তীব্রতর করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞাগুলো শেখ হাসিনার সরকারের সুস্পষ্ট মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণকে ধীর করার জন্য যথেষ্ট কাজ করেনি।
মার্কিন আইনপ্রণেতারা বলেন, নিজেদের লোকদের বিরুদ্ধে অপরাধের পাশাপাশি হাসিনার অসদাচরণ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য খারাপ অভিনেতাদের সাধারণ জোট করতে উৎসাহিত করে। আর আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে তা আঘাত করে। কারণ তারা একত্রিত হয় এবং চীন ও রাশিয়ার কাছাকাছি আসে।
কংগ্রেসম্যানরা বাংলাদেশকে অবাধ নির্বাচনের জন্য তাদের সর্বোত্তম সুযোগ দেওয়ার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করেন, যার মধ্যে রয়েছে কঠোর ব্যক্তিগত নিষেধাজ্ঞা, বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং সামরিক কর্মীদের জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করা। চিঠিতে স্বাক্ষরদানকারীদের মধ্যে রয়েছেন কংগ্রেস সদস্য স্কট পেরি, ব্যারি মুর, ওয়ারেন ডেভিডসন, বব গুড, টিম বারচেট ও কিথ সেলফ।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা জারির প্রথম ফল হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে গাজীপুরে সরকারি দলের প্রার্থীর হেরে যাওয়াকে। সরকারের ভেতরের একটি সূত্র জানিয়েছে, বগুড়ায় হিরো আলমের নির্বাচনের মতোই গাজীপুরে সরকারি দল মনোনীত প্রার্থী আজমত উল্লাকে বিজয়ী ঘোষণার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু এটি করা হলে নির্বাচন কমিশন ভিসা নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়তে পারে আশঙ্কায় তা করতে রাজি হয়নি। অন্যদিকে আগামী ৫ জুন বিক্ষোভ কর্মসূচির অনুমতি চাইতে ডিএমপিতে গেলে ডিবি পুলিশ ৪ জামায়াত নেতাকে আটক করে। গত ২৯ মে সোমবার দুপুরে কর্মসূচিতে সহযোগিতার আবেদন নিয়ে ডিএমপিতে যান তারা। সেখান থেকে পুলিশ চারজনকে আটক করে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, জামায়াতের আমীরের মুক্তি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দাবিতে এ বিক্ষোভ কর্মসূচির আয়োজন করতে চেয়েছিল জামায়াত।
কিন্তু সেদিন বিকেলেই জামায়াতের এ চার নেতাকে ছেড়ে দিয়েছে পুলিশ। বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন ডিএমপির গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার কে এন রায় নিয়তি। তিনি বলেন, জামায়াতের চারজনকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ভিসা নিষেধাজ্ঞা জারির পর বিএনপির কর্মসূচিতে বাধাদানের ঘটনাও কমে এসেছে। এ নিষেধাজ্ঞা জারির বাস্তবায়ন শুরু হলে এর মাঠপর্যায়ে আরো প্রভাব পড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

Please follow and like us:

Check Also

২৮শে এপ্রিল খুলছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শনিবারেও ক্লাসের পরিকল্পনা

আগামী ২৮শে এপ্রিল থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার জন্য সব রকমের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।