যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নতুন ভিসা নীতি গ্রহণ করছে সরকার?

মাসখানেকের কিছু বেশি সময় আগে (২৪ মে) বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসা নীতি গ্রহণ করে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট তথা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ প্রসঙ্গে মুখপাত্রের বরাতে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেনের বক্তব্য নিজেদের ওয়েবসাইটে জুড়ে দেয় স্টেট ডিপার্টমেন্ট, যার শিরোনাম বাংলা করলে দাঁড়ায়- ‘বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের প্রচারে (নতুন) ভিসা নীতির ঘোষণা’। ওই ঘোষণার কিছু সময় বাদেই দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু জানান, নতুন নীতির মাধ্যমে তাদের সরকার সেইসব ব্যক্তিদের ভিসা সুবিধায় বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারবে, যারা বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত করবে। যে কেউ এর আওতায় পড়তে পারেন, সরকারের লোকজন, বিচার বিভাগের সদস্য, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বা বিরোধী দলের কেউ। দক্ষিণ এশিয়া এবং সারা বিশ্বে নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে যেতে হলে বাংলাদেশের জন্য গণতন্ত্র রক্ষার বিষয়টি একইসঙ্গে প্রয়োজনীয় এবং অপরিহার্য বলেও তিনি মন্তব্য করেন। অবশ্য এর ঠিক আগের মাসেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেনের সঙ্গে ওয়াশিংটনের বৈঠকে ব্লিনকেনও একই সুরে বলেছিলেন, “বিশ্ব আগামী নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে আছে। অবশ্য আমরাও তাকিয়ে আছি, যাতে বাংলাদেশ এই অঞ্চল ও বিশ্বের জন্য অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের শক্তিশালী উদাহরণ তৈরি করতে পারে।”

ডোনাল্ড লুর মুখ থেকে আমরা এটাও জানতে পারি যে, ৩রা মে অর্থাৎ প্রকাশ্য ঘোষণার ঠিক তিন সপ্তাহ আগেই বাংলাদেশ সরকারকে নতুন এই নীতির বিষয়ে অবহিত করা হয়েছিল। কিন্তু, বাংলাদেশ সরকার বা সুনির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তি নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়তে যাচ্ছেন বা পড়েছেন বলে বাজারে জোর গুজব থাকলেও সরকারের পক্ষ থেকে জনগণকে কিছুই জানানো হয়নি! যাই হোক, এ নিয়ে জল অনেক ঘোলা করা হয়েছে। সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী থেকে শুরু করে দায়িত্বশীল লোকজন, এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকেও আমরা নানা কথা শুনেছি। সরকার এবং আওয়ামী লীগের অনেকেই ভিসা নীতির খবর প্রকাশ্যে আসার পর যুক্তরাষ্ট্রের অভিনব এই উদ্যোগটিকে স্বাগত জানিয়েছেন এমন সব যুক্তিতে যে, ‘এটা সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে সহায়ক হবে, যেটা সরকারও চায়।

বিজ্ঞাপন

এই নীতি করা হয়েছে বিএনপির জন্যই যাতে তারা নির্বাচনকে ভন্ডুল না করতে পারে, এর ফলে বিএনপি আন্দোলনের নামে জ্বালাও-পোড়াও করা থেকে পিছিয়ে আসতে বাধ্য হবে।’
তবে, ভিসা নীতি ঘোষণার কয়েকদিন বাদেই সরকারের একেবারে শীর্ষ মহল থেকে এই নীতি এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নানা ধরনের বক্তব্য দেওয়া হয়। ঠিক ১০ দিন পর (০৩ জুন) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “কে আমাদের ভিসা দেবে না, কে আমাদের স্যাংশন দেবে, ওনিয়ে মাথাব্যথা করে কোন লাভ নাই।” তিনি বলেন, “বিশ ঘণ্টা প্লেনে জার্নি করে, আটলান্টিক পার হয়ে, ঐ আমেরিকায় না গেলে কিচ্ছু আসে যায় না। পৃথিবীতে আরো অনেক মহাসাগর আছে, অনেক মহাদেশ আছে। সেই মহাদেশের সাথে মহাসাগরেই আমরা যাতায়াত করবো আর বন্ধুত্ব করবো। আমাদের অর্থনীতি আরো মজবুত হবে, আরো উন্নত হবে, আরো চাঙা হবে।” যুক্তরাষ্ট্রের নাম উল্লেখ না করে তিনি বলেন, তাদের উচিত বিএনপির দিকে নজর দেয়া (সূত্র: বিবিসি বাংলা)। এটা লক্ষণীয় যে, ভিসা নীতির খবর যুক্তরাষ্ট্র সবাইকে প্রকাশ্যে জানিয়ে দেওয়ার পর শুরুতে সরকারের তরফে যদিও বলা হচ্ছিল ‘এতে বিএনপির আনন্দিত হওয়ার কিছু নেই, এটা বিএনপির বিরুদ্ধেই যাবে’, কিন্তু দিন দশেক বাদে খোদ প্রধানমন্ত্রীই বলেন, তাদের বিএনপির দিকে চোখ রাখা উচিত!

সবকিছু এভাবেই চললেও সরকারের তরফে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণের ঘোষণাটি সর্বপ্রথম আসে সম্ভবত প্রধানমন্ত্রীর পর আওয়ামী লীগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদের অধিকারী, দলের সাধারণ সম্পাদক এবং গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের মুখ থেকে। ভিসা নীতি ঘোষণার দুই সপ্তাহ বাদে (৮ জুন) তিনি বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র কাকে ভিসা দেবে, কাকে দেবে না- এটা সেই দেশের ব্যাপার। আমরাও আমাদের দেশে কাকে ভিসা দেবো, কাকে দেবো না- সেটাও আমাদের ব্যাপার” (সূত্র: বণিকবার্তা)। এরপর (১৭ জুন) তিনি বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নীতি করুক তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না। ভিসা নীতি আমাদেরও থাকতে পারে। আমরাও করতে পারি। অপেক্ষায় থাকুন।” যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র এবং বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যে নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় এসেছেন সেই নির্বাচনকেও তিনি প্রশ্নবিদ্ধ করেন। কাদের বলেন, “ক্যাপিটাল হিলে তাদের দেশের ৯ জন লোক মারা গেল, কিন্তু ট্রাম্প গতকালও বলেছে, আমার বিরুদ্ধে মামলা করা হচ্ছে ফর স্টিলিং অ্যান্ড রিগিং ইলেকশন। এখনো গত নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেয়নি। তো এই ডেমোক্রেসি নিয়ে তো প্রশ্ন আছেই” (সূত্র: মানবজমিন)।

এমন বক্তব্য সেখানেই থেমে থাকে নি। মঙ্গলবার (২৭ জুন) নিজ এলাকা ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, “যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতির কথা বলতেছে, বাংলাদেশও তো ভিসানীতির কথা বলতে পারে। ভিসানীতি দিছে তো কী হয়েছে?” তিনি বলেন, “আমার সঙ্গে যখন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাম্বাসেডর সাহেবের কথা হয়েছে, তখন তিনি বললেন, আমি এসেছি ভিসানীতি কী তা বোঝাতে। আপনি কী বলবেন? আমি বললাম, এটা আওয়ামী লীগ বা বিএনপি যার বিরুদ্ধেই ব্যবহার করেন, সার্বভৌম দেশ হিসেবে আমি অপমানিত বোধ করেছি। কারণ, বাংলাদেশ একটি সার্বভৌম দেশ। তারপর বলেছি, আপনারা বলেছেন অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য এটা করেছেন। আপনারা যদি পক্ষপাতিত্ব না করে এটা প্রয়োগ করেন, আমাদের আপত্তি নেই। আপনারা যদি একজনের বিরুদ্ধে এটা প্রয়োগ করেন, তাহলে অবশ্যই আমার কিছু বলার আছে। তারপর বলেছি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দেশ আপনার। আপনারা ভিসানীতি দিয়েছেন, তাতে আমার কিছু আসে যায় না” (সূত্র: জাগোনিউজ)।

লক্ষণীয় যে, ওবায়দুল কাদের যুক্তরাষ্ট্রের জন্য (নাম না নিয়েই) বাংলাদেশের নতুন ভিসা নীতি গ্রহণের কথা জানিয়ে অপেক্ষা করতে বললেও ঠিক কতোদিন আমাদের অপেক্ষা করতে হবে সেটা বলেন নি! আবার বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্র নতুন ভিসা নীতি গ্রহণ করায় আইনমন্ত্রী সার্বভৌম দেশের নাগরিক হিসেবে অপমানিত বোধ করার কথা বললেও তার পরবর্তী বক্তব্য এর সাথে সাংঘর্ষিক। কারণ, তিনি নিজেই দাবি করেছেন যে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতকে বলেছেন- দেশ আপনার, আপনাদের ভিসা নীতিতে আমাদের কিছু যায় আসে না। তাছাড়া, ‘বাংলাদেশও ভিসা নীতির কথা বলতে পারে’ মুখে এমনটি বললেও সরকার বাস্তবে কি তা বলবে, বা বললেও কোন পদ্ধতি অনুসরণ করে বলবে তাও কিন্তু তিনি স্পষ্ট করেন নি। নিজ দেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্তিয়ায় কেউ বাধা দিলে সেটি বেশি অপমানের নাকি বাধাদানকারীদের বিরুদ্ধে ভিন্ন কোনো গণতান্ত্রিক দেশ আগাম ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানালে সেটি বেশি অপমানের তাও তিনি খোলাসা করেন নি।

Please follow and like us:

Check Also

ফেলোশিপে সিঙ্গাপুর যাচ্ছেন সামেকের ডা. মাহমুদুল হাসান পলাশ

সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক স্পাইন ও অর্থোপেডিক সার্জারির আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘এও স্পাইন’ এর ফেলোশিপ নিয়ে সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।