- ভারতের কাঁচামরিচ এলে দাম কমার আশা
- প্রচন্ড খরা-তাপে গাছ মরে গেছে, যেগুলো বেঁচে আছে তাতে তেমন মরিচ ধরছে না
- হিলির ৬ আমদানিকারক ২৭৫০০ মেট্রিক টন আমদানির অনুমতি পেয়েছে, ২৭ টন আসার পরই ঈদের ছুটি শুরু হয়
আমদানির অনুমতি দেওয়াসহ সরকারের কোনো পদক্ষেপই কাঁচামরিচের চড়া দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। ঈদের মধ্যেই এই কাঁচালঙ্কা নিয়ে দশজুড়ে লঙ্কাকাণ্ড বেঁধে গেছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে একেক দামে বিক্রি হচ্ছে কাঁচামরিচ। শনিবার ঝিনাইদহের শৈলকুপায় প্রতি কেজি কাঁচামরিচ এক হাজার টাকায় বিক্রির খবর পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমদানির কাঁচামরিচ দেশে ঢুকলে দাম কমবে।
রাজধানীর রামপুরা, মধুবাগ ও মালিবাগ ও কারওয়ান বাজারে শনিবার ৫০০ থেকে ৭০০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে কাঁচামরিচ। তবে কোথাও ৫০০ টাকার নিচে কাঁচামরিচ কেনা যাচ্ছে না। পাইকারি বাজারে কাঁচামরিচের দাম বাড়লেও খুচরা বাজারের সঙ্গে দামে দ্বিগুণ ব্যবধান। ১৫ দিন আগেও খুচরা বাজারে প্রতি কেজি সর্বোচ্চ ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছিল। আর পাইকারি বাজারে ছিল ৩০ থেকে ৪০ টাকা কেজি।
হঠাৎ এই দাম বাড়াকে স্বাভাবিক বলে মনে করছেন না বাজার বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, ‘এসব সিন্ডিকেটের কারসাজি।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, প্রচন্ড খরা ও তাপ এবং হঠাৎ করে অতিবৃষ্টি হওয়ায় কাঁচামরিচের উৎপাদন কিছুটা কমেছে। কিছু মরিচ নষ্টও হয়ে গেছে। এতেও এমন কোনো সংকট সৃষ্টি হতে পারে না। এর ভিন্ন কারণ রয়েছে।
ঈদের এক সপ্তাহ আগে থেকেই কাঁচা মরিচের দাম তরতর করে বেড়ে যাওয়ায় গত ২৫ জুন কাঁচামরিচ আমদানির অনুমতি দেয় সরকার।
হিলি স্থলবন্দর উদ্ভিদ সংঘনিরোধ কেন্দ্রের উপসহকারী মো. ইউসুফ আলী জানান, গেল বছরের ২৪ আগস্ট থেকে কাঁচা মরিচ আমদানি বন্ধ ছিল। সরকার অনুমতি দেওয়ার পর ২৬ জুন থেকেই হিলি বন্দর দিয়ে ভারত থেকে কাঁচা মরিচ আমদানি শুরু হয়। হিলির ছয় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান এই পর্যন্ত ২৭ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন কাঁচা মরিচ আমদানির অনুমতি পেয়েছেন। ইতোমধ্যেই ২৭ মেট্রিক টন কাঁচামরিচ এসেছে। ঈদের বন্ধের কারণে আর কাঁচামরিচ আসেনি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভারত থেকে সাধারণত হিলি স্থল বন্দর হয়ে আমদানির কাঁচামরিচ দেশে আসে। ২৭ জুন থেকে হিলি বন্দরে ঈদের ছুটি শুরু হয়েছে। আগামীকাল সোমবার হিলি বন্দর থেকে আমদানি-রপ্তানি শুরু হবে। তখন আমাদনির কাঁচামরিচ আসবে প্রচুর পরিমানে। তখন দাম নিয়ন্ত্রণে আসবে। কেননা- বাংলাদেশের সীমান্ত ঘেষা ভারতের বাজারে কাঁচামরিচ খুরচা পর্যায়েই বিক্রি হচ্ছে ২৫-৩০ টাকা। সেক্ষেত্রে ভারত থেকে কাঁচামরিচ আনলে দাম কম পড়বে, যা কম দামেই বাজারে বিক্রি হবে। সেই প্রভাবে কাঁচামরিচের দাম কমে আসবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ শাখা জানিয়েছে, বাজারে কাঁচা মরিচের দাম অন্য সময়ের দামের তুলনায় অনেক বেশি। ফলে বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে কাঁচা মরিচ আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। সরকারের তরফ থেকে আশা করা হচ্ছে, দ্রুত বাজারে কাঁচা মরিচের সরবরাহ বাড়বে এবং দাম কমে আসবে।
অধিদপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘বাজারে কাঁচা মরিচের দাম বেড়ে যাওয়ার পর মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কথা বলে আমাদের প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য বলেন। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী কাঁচা মরিচ আমদানির অনুমতি (আইপি) দেওয়া হয়েছে।’
আমদানিকারকেরা বলছেন, বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী ভারতের সীমান্ত এলাকার বাজারগুলোয় প্রতি কেজি কাঁচা মরিচের দাম ২৫ থেকে ৩০ টাকার মধ্যে রয়েছে। তাতে ভারতীয় কাঁচা মরিচ দেশে এলে সব খরচ বাদ দিয়ে খুচরা বাজারে প্রতি কেজি দামর ৮০ থেকে ১০০ টাকার মধ্যে চলে আসবে।
শৈলকুপায় কাঁচামরিচ হাজার টাকা
শৈলকূপা উপজেলার হাটবাজারে কাঁচামরিচের দাম আকাশছোঁয়া। প্রতিকেজি কাঁচা মরিচ ৯শ’ থেকে এক হাজার টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
শনিবার শৈলকূপা হাটে কাঁচামরিচের প্রকট সঙ্কট দেখা গেছে। ব্যবসায়ীরা জানান, কৃষকরা বৃষ্টি না হওয়ার কারণে মরিচের ফলন অনেক কম হয়েছে। ওই কারণে ঈদের আগে থেকেই কাঁচামরিচের দাম বাড়তে শুরু করেছে। বর্তমানে বাজারে কাঁচামরিচের তীব্র সংকট রয়েছে।
কাঁচামরিচ ব্যবসায়ী কামাল হোসেন জানান, বগুড়া জেলাসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে শৈলকুপায় কাঁচামরিচ আসে। কিন্তু এখন সেখান থেকে মরিচ আসছে না। এ কারণে কাঁচামরিচের দাম বেড়েছে।
এদিকে কাঁচামরিচের দাম বাজারে অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় এ পণ্যটি জনসাধারণের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। তারা কাঁচমরিচের পরিবর্তে বাজার থেকে শুকনা মরিচ কেনার দিকে ঝুঁকে পড়ছে।
কাঁচাবাজার করতে আসা জাহিদ নামের এক ব্যক্তি বলেন, ১০০ গ্রাম কাঁচামরিচ কিনলাম ১০০ টাকা দিয়ে, যা আমার জীবনে নজিরবিহীন।
মানিকগঞ্জে পাইকারিতে ২২০ টাকা, খুচরা বাজারে ৫০০:
আমাদের মানিকগঞ্জ সংবাদদাতা জানিয়েছেন, মানিকগঞ্জের খুচরা বাজারে মরিচের দাম কেজিপ্রতি ৫০০ টাকা হলেও পাইকারি বাজারে দাম ২২০-২৫০ টাকা।
মরিচের উৎপাদন কমে যাওয়ায় হঠাৎ দাম বেড়ে গেছে বলে জানান পাইকার ও মরিচ চাষিরা। তবে মধ্যসত্ত্বভোগীদের কারণে মরিচের দাম বাড়ছে বলে দাবি ক্রেতাদের।
মানিকগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় এবার ৩ হাজার ২৯১ হেক্টর জমিতে মরিচের আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। আবাদ হয় ৩ হাজার ৫৪১ হেক্টর জমিতে, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২৫০ হেক্টর বেশি।
বরঙ্গাইল বাজারের আড়তদার মো. সাইদুর রহমান জানান, এ বাজারে ৩২ জন আড়তদার আছেন। এ অঞ্চলের উৎপাদিত মরিচ দেশের বড় বড় বাজারে যায়। দেশের চাহিদা পূরণ করে কুয়েত, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ বহু দেশে মরিচ রপ্তানি হয়।
সাইদুর রহমান বলেন, ‘এবার গাছগুলো থুবরে পড়ায় মরিচ ধরছে না। উৎপাদন খুবই কমে গেছে। আড়তে মরিচ আসছে না। প্রয়োজনের তুলনায় উৎপাদন কম হওয়ায় হঠাৎ মরিচের দাম বেড়ে গেছে।’
সাইদুর বলেন, ‘আমি সোমবার ২০০-২৬০ টাকা দরে ১০০ কেজি মরিচ কিনেছি। এই মরিচ সাতক্ষীরা জেলায় পাঠাব। এত অল্প মরিচ কিনে সেখানে পাঠাতে যে খরচ, তাতে পোষায় না। দাম এভাবেই বেড়ে যাচ্ছে।’
রঘুনাথপুর গ্রামের মরিচ চাষি বিল্লাল হোসেন ৫ বিঘা জমিতে মরিচ আবাদ করেছেন। তিনি বলেন, ‘দেড় লাখ টাকার বেশি খরচ হয়েছে। এ পর্যন্ত ৫০ কেজি মরিচ তুলে ৩ হাজার টাকায় বিক্রি করছি। গাছে আর মরিচ নাই। গাছ মরে যাচ্ছে। অতিরিক্ত তাপ আর খরার কারণেই গাছের এই অবস্থা হয়েছে।’
ঘিওর উপজেলার শ্রীবাড়ি গ্রামের মো. ইউসুফ আলী বলেন, ‘১৫ শতাংশ জমিতে মরিচের আবাদ করেছি। বৈশাখে মরিচের চাষ হয়। চার থেকে সাড়ে চার মাস ফলন হয়। কিন্তু এবার আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় মরিচ গাছ থুবরে গেছে এবং ফলন হচ্ছে না। প্রথম দিকে অল্প ফলন হলেও গত ২ সপ্তাহ ধরে মরিচ ধরছে না। এখন তো আমাদেরও মরিচ কিনে খেতে হবে।’
হরিরামপুর উপজেলার গোড়াইল গ্রামের কৃষক সোরহাব বেপারী জানান, ‘গাছ মরে যাচ্ছে, ফলন হচ্ছে না।’
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয়ের উপপরিচালক আবু মোঃ এনায়েত উল্লাহ বলেন, ‘এবার অতিরিক্ত তাপে ও খরায় মরিচ গাছ থুবরে গেছে। অনেক গাছ মরে গেছে। উৎপাদন কমে গেছে। মরিচ চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।’
‘গত বারের চেয়ে এবার মরিচের আবাদ বেশি হয়েছে। তবে আগামীতে মরিচের আবাদ কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে,’ যোগ করেন তিনি।