গায়েবি মামলা অব্যাহত থাকলে সুষ্ঠু নির্বাচন অসম্ভব: আসিফ নজরুল

অনেক সময় পুলিশ বলে, বর্তমান সরকারকে টিকিয়ে রেখেছি আমরা। এটা যতটা না হামলা করে এর থেকে অনেক বেশি গায়েবি মামলা করে। রাজনৈতিক এসব মামলার প্রধান কাজ হচ্ছে ভুয়া নির্বাচন সাধন করা। এতে সরকার অবাধে কারচুপি করতে পারে। এজন্য নির্বাচনের আগে গায়েবি মামলা দেয়া হয়। এই মামলা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচন করা অসম্ভব বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল।

রোববার সকাল ১০টায় ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজের আয়োজনে ‘গায়েবি মামলা ও আগামী নির্বাচন’ শীর্ষক ওয়েবিনারে তিনি এসব কথা বলেন। সাংবাদিক মনির হায়দারের সঞ্চালনায় ওয়েবিনায়ারে আসিফ নজরুল আরও বলেন, গায়েবি মামলা এক ধরনের মিথ্যা মামলা যেটা শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণে করা হয়। কখনো এটি মিথ্যা মামলা কখনো এটি অতিরঞ্জিত করে করা হয়। অধিকাংশ মামলা করা হয় একেবারেই বানিয়ে। এই মামলাগুলো করে পুলিশ কিংবা তার সোর্স।

 

সাম্প্রতিককালে দেখা যায়, সরকারি দলীয় নেতাকর্মীরাও এগুলো করছে। এই মামলা শুধুমাত্র বিরোধীদলের বিপক্ষে করা হয়। এতে বিপুল সংখ্যক লোককে আসামি করা হয়। এমন ঘটনাও হয় যে একজনকে ১২০ জন মিলিয়ে পিটিয়েছে। এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের এলাকা ছাড়া করা এবং ভীত সন্ত্রস্ত রাখা। এই মামলাগুলো উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে নির্বাচনের আগে বেশি বেশি করা হয়। তাহলে সরকারি দল অবাধে নির্বাচনে কারচুপি করতে পারে। এই ধরনের মামলা সরকারি দলের কারো উপর করা হয়েছে এমন নজির মেলেনি।
তিনি বলেন, অধিকাংশ মামলা হয় নির্বাচনের আগে কিংবা বিরোধী দল বড় বড় কর্মসূচি দিলে। গত বছর নভেম্বর ডিসেম্বরে যখন বিরোধীদল কর্মসূচি দিচ্ছিল তখন অনেকগুলো গায়েবি মামলা দেয়া হয়। এই মামলাগুলোতে দুটো কারণে অজ্ঞাতনামা আসামি রাখা হয়। বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীরা শঙ্কায় থাকে যে, আমার নাম না থাকলেও এতে আমাকে যুক্ত করা যাবে। আবার পুলিশ যদি কাউকে গ্রেপ্তার করে তার বিরুদ্ধে যদি কোন মামলা নাও থাকে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি হিসেবে কোন একটা মামলায় ঢুকিয়ে দেয়া যায়।
তিনি বলেন, ২০১৮ সালে শুধু সেপ্টেম্বর মাসে প্রথম ২০ দিনে ৩৭৩৬টি মামলা দায়ের করে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। এটা হাইকোর্টের তথ্য বানিয়ে বলার সুযোগ নাই। এতে আসামি করা হয় ৩ লাখ ১৩ হাজার ১৩০ জনকে। আসামিদের মধ্যে মৃত, বিদেশে থাকা এবং গ্রেপ্তার হওয়া লোকও ছিল। এই মামলায় আদালত মন্তব্য করে, এই ধরনের মামলায় পুলিশের ভাবমূর্তি ও বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়। বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী রিটটি আমলে নিয়ে ৬০ দিনের মধ্যে পুলিশের আইজিপিকে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেন। এসব গায়েবি মামলায় কেন আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না তা জানাতে রুল জারি করেন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে অপর বিচারপতি রিটটি আইন বহির্ভূত আখ্যা দিয়ে তা খারিজ করেন।

জাতীয় একটি দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদের রেফারেন্স দিয়ে ড. আসিফ নজরুল বলেন, গত বছরের নভেম্বর মাস থেকে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত ৫০টি মামলা করা হয়, শুধু ঢাকা মহানগরে। ৪৫টি মামলাই করা হয় গত বছর নভেম্বর-ডিসেম্বরে। তখন বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশ হচ্ছিল এবং প্রচুর লোকসমাগম হয়। এখানে ১৭০১ জনের নাম উল্লেখ করে ২৫৭৫ জনকে আসামি করা হয়। মামলা যারা দায়ের করেছেন তারা ক্ষমতাসীন দলের নেতা। প্রত্যেকটা মামলায় ককটেল বিস্ফোরণের কথা বলা হয়। এর মধ্যে ১৭টা মামলার মধ্যে দেখা যায় ১৫টা মামলায় আওয়ামী লীগের ওপর কোন হামলাই হয়নি। ককটেল বিস্ফোরণের কথাও শোনেনি এলাকাবাসী। আর দুটা মামলায় ককটেল বিস্ফোরণ হয়। এলাকার প্রতিবেশী বলছেন, কে করেছে তারা জানেই না। সূত্রাপুর থানায় একজন মামলার বাদী বলছেন, উনি বিরোধী দলের বিরুদ্ধে ইটপাটকেল ছোড়ার অভিযোগ করলে পুলিশ আলামত হিসেবে ককটেল উদ্ধার করে। সেখানে বাদী জানায়, ককটেল বিস্ফোরণের কোন ঘটনাই ঘটেনি।

আরেকটি মামলার প্রসঙ্গে বলেন, ককটেল জব্দ তালিকার স্বাক্ষী বলেন, ককটেল বিস্ফোরণের কোন ঘটনা ঘটে নাই। বাদী কাগজে সই দিতে বললে তিনি দেন। এই মামলা করেছিলেন একজন স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা। প্রতিটা মামলার বিএনপির লোকেরা আওয়ামী লীগের ওপর হামলা করে এবং একপর্যায়ে ককটেল বিস্ফোরণ করেছে বলে বলা হয়।

গেন্ডারিয়া থানায় দায়ের হওয়া একটা মামলার প্রসঙ্গে বলেন, এজাহারে বলা হয় গেন্ডারিয়া থানার আওয়ামী লীগের সভাপতি হামলায় আহত হন। কিন্তু তিনি নিজে গণমাধ্যমকে বলেন, ওই দিন তার উপর কোন হামলা হয় নাই। ৪৫নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক উনার উপর হামলা হয়েছে শুনে বিস্ময় প্রকাশ করেন এবং মামলার বাদীকে চেনেন না বলে জানান। প্রত্যেক মামলায় ককটেল ঢুকানো হয়, কারণ বিস্ফোরক আইনের অধীনে মামলার বিচার দ্রুত নিষ্পত্তি করা যায় এবং জামিন অযোগ্য মামলা। দুই ধারার মামলা করা হয়। এগুলোর সর্বোচ্চ শাস্তি ১২ ও ২০ বছরের কারাদণ্ড। আবার বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করা হয়। যার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। এই কারণে এই মামলার আসামিরা ভীত থাকেন। কারণ গ্রেপ্তার হলে জামিন মিলবে না, দ্রুত সাজা হয়ে যেতে পারে।
তিনি বলেন, আমার পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, গায়েবি মামলা করা হলে চলাচল, সমাবেত হওয়া, সভা সমাবেশ, বাক স্বাধীনতা নষ্ট হয়, জীবন জীবিকা হুমকির মুখে পড়ে এবং নির্বাচনের সমতল ভূমি বিপর্যস্ত হয়। সংবিধান অনুযায়ী এই ধরনের মামলা প্রশ্নবিদ্ধ এবং পুলিশের ভূমিকা অত্যন্ত প্রশ্নবিদ্ধ। এখন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও পুলিশের সোর্সরাও মামলা করছেন। এর উদ্দেশ্য আসামিদের মধ্যে ভীতি সৃষ্টি করা। আবার এসব ক্ষেত্রে পুলিশকে অনেক বেশি উৎসাহিত দেখা যায়।

ওয়েবনিয়ারে আলোচক হিসেবে আরও যুক্ত ছিলেন সাবেক বিচারপতি এমএ মতিন, অস্ট্রেলিয়ার চার্লস ডারউইন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র আইন কর্মকর্তা ড. রিদওয়ানুল হক ও বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকমের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক গোলাম মতুর্জা অন্তু। ওয়েবিনারের সমাপনী বক্তব্য রাখেন ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের শিক্ষক জাহেদ উর রহমান।

Please follow and like us:

Check Also

সাতক্ষীরায় ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক সেন্টার,হোটেল রেস্তোরা ও বেকারি শ্রমিক ইউনিয়ন ও জেলা হোটেল শ্রমিক ইউনিয়নের উদ্যোগে র‌্যালি ও আলোচনা সভা

সাতক্ষীরায় ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ১১তম বছর পূর্তি উপলক্ষে র‌্যালি, কেক কাটা ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।