সুন্দরবনে ১৫৩ জন প্রভাবশালী বাঘশিকারি সক্রিয় ১৫টি দেশে পাচার হচ্ছে বাঘের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ

আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরাঃ বিদেশে পাচার হচ্ছে সুন্দরবনের বাঘের হাড় ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। বিশ্বের ১৫টি দেশে সুন্দরবনের বাঘের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পাচার হচ্ছে। বাঘের চোরাচালান ও পাচারে ১৫৩ জন প্রভাবশালী ব্যক্তি জড়িত। বাঘের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পাচারের ওই চক্রের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ভারত, চীন ও মালয়েশিয়ার একদল চোরাচালানকারী। আর এগুলোর সবচেয়ে বড় ক্রেতা কাতার, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের মতো দেশগুলো। সুন্দরবনে বাঘশিকারি দস্যুরা এখনো সক্রিয় আছে। বাংলাদেশে অবৈধভাবে বাঘ পাচারের জন্য সুবিধাজনক অবকাঠামো দিন দিন বাড়ছে। বাংলাদেশে সুন্দরবন অংশে প্রতি বছর তিনটিরও বেশি বাঘ চোরাশিকারিদের হাতে নিহত হচ্ছে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে বন্যপ্রাণী চোরাচালানের ওপর নজরদারিকারী সংস্থা “ট্রাফিক”। প্রতিবেদনটিতে তারা বলেছে, বাংলাদেশে খুব অল্প সংখ্যায় বাঘ অবশিষ্ট থাকলেও চামড়া, দাঁত, হাড়, মাথার খুলি ও অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের জন্য বাঘ হত্যার প্রবণতা বাড়তির দিকে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গত ২০ বছরে বাংলাদেশে ৫১টি বাঘ হত্যা করা হয়েছে। ২০১৫ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যের সময়টাতে প্রতিবছর গড়ে ৩.১টি বাঘ চোরা শিকারীদের হাতে প্রাণ হারিয়েছে। অথচ ২০০০ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে বছরে গড়ে ২টি বাঘ শিকারের ঘটনা ছিল। ২০০০ থেকে ২০১৮ সালের বিশ্বজুড়ে বাঘ সংক্রান্ত তথ্য সম্বলিত এই প্রতিবেদনে বলা হয়, এই সময়ের মধ্যে ৩২টি দেশ ও অঞ্চলে কম করে হলেও ২৩৫৯টি বাঘ হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে ১১৪২ টি ক্ষেত্রে বাঘের দেহাবশেষ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে, যার বেশিরভাগ ঘটনাই আবার এশিয়া অঞ্চলে। বিশ্বজুড়ে বাঘ হত্যার ঘটনাগুলোর মধ্যে ৯৫.১ শতাংশ (১০৮৬টি ঘটনা) ঘটেছে এশিয়ার ১৩টি দেশে যাতে প্রাণ হারিয়েছে ২,২৪১টি বাঘ। প্রতিবছর গড়ে ১২৪টি বাঘের দেহ উদ্ধার করা হচ্ছে।
সাতক্ষীরার সুন্দরবনসংলগ্ন একটি গ্রাম থেকে বোতলে ভরা বাঘের হাড়ের গুঁড়া কিনলেন একজন ক্রেতা। সেটি নিয়ে প্রথমে তিনি ঢাকায় এলেন। তারপর বাসে করে সিলেটে। সেখান থেকে একজন উড়োজাহাজে করে সরাসরি যুক্তরাজ্যের লন্ডনে। আরেকজন সিলেট থেকে হাড়ের গুঁড়া নিয়ে সীমান্তপাড়ি দিয়ে ভারতের আসামে চলে গেলেন। শুধু সিলেট নয়, ঢাকা থেকে আন্তর্জাতিক বিমানে এবং চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর দিয়ে নিয়মিতভাবে বাঘের হাড়সহ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পাচার হচ্ছে।
একদল গবেষক দীর্ঘ পাঁচ বছর বাংলাদেশ থেকে বাঘ এবং বাঘের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ চোরাচালান নিয়ে অনুসন্ধান ও জরিপের মাধ্যমে গবেষণা করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বন্য প্রাণী গবেষণা সংস্থা প্যানথেরা এবং চীনভিত্তিক সংস্থা চায়নিজ একাডেমি অব সায়েন্সেসের গবেষকেরা যৌথভাবে গবেষণাটি করেছেন। এর ফলাফল চলতি বছর আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী কনজারভেশন সায়েন্স ও প্র্যাকটিস-এ প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনে বাংলাদেশের সুন্দরবন ছাড়াও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং উত্তর মিয়ানমার অঞ্চলে ওই বাঘ শিকার ও চোরাচালান চক্রটি সক্রিয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। গবেষণাটির প্রয়োজনে ১৯৪ জনের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে; যাঁরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বাঘ শিকার ও চোরাকারবারের সঙ্গে জড়িত।গবেষণায় বলা হয়েছে, বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনভূমি বাংলাদেশের সুন্দরবন ৩০টি জলদস্যু দল নিয়ন্ত্রণ করত। চাঁদাবাজি, অপহরণ, বনজীবীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় ইত্যাদি তাদের নিত্যনৈমিত্তিক কাজ ছিল। তাদের মধ্যে অন্তত সাতটি জলদস্যু দল প্রত্যক্ষভাবে বাঘ শিকারে অংশ নিত। বাঘের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ চোরাচালানেও তারা যুক্ত ছিল। ২০০৯ সালেও সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা ৩০০ থেকে ৫০০ ছিল। ২০১৮ সালে তা কমে আনুমানিক ১১৪টিতে নেমে আসে। বাংলাদেশ সরকারের ২০১৬ সালের জলদস্যুতা প্রতিরোধ অভিযান জলদস্যু গোষ্ঠীগুলোকে সাধারণ ক্ষমার প্রস্তাব দেয়। যারা প্রত্যাখ্যান করে, তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হয়। এভাবে কয়েক বছরের মধ্যে অঞ্চলটিকে জলদস্যুমুক্ত ঘোষণা করা হয়। তবে জলদস্যুরা চলে যাওয়ার পর তাদের শূন্যস্থান দখল করেছে প্রায় ৩২টি বাঘ চোরাচালানকারী চক্র।
গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অনেক এলাকায় বাঘের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ব্যবহারের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য। ধনী বাংলাদেশি নাগরিকেরা ঔষধি কাজে, আধ্যাত্মিক উপাদান হিসেবে এবং ঘর সাজানোর শৌখিন পণ্য হিসেবে বাঘের শরীরের অংশবিশেষ যেমন হাড়, কাটা দাঁত, মাংস, দুধ, মাথার খুলি, চামড়া ইত্যাদি ব্যবহার করেন। অনেক ক্ষেত্রে দৈহিক শক্তি বাড়াতে অনেকে বাঘের মাংস পর্যন্তখান। বাঘের দাঁত ও নখ শক্তির প্রতীক হিসেবে এবং খারাপ আত্মাকে তাড়ানোর জন্য ব্যবহার করা হয়।
বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালের জরিপে সুন্দরবনে ৩৫০টি বাঘ ছিল। এরপর ১৯৮২ সালে জরিপে৪২৫টি ও এর দুই বছর পর ১৯৮৪ সালে সুন্দরবন দক্ষিণ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের ১১০ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় জরিপ চালিয়ে৪৩০ থেকে ৪৫০টি বাঘ থাকার কথা জানানো হয়। ১৯৯২ সালে ৩৫৯টি বাঘ থাকার তথ্য জানায় বন বিভাগ। পরের বছর ১৯৯৩ সালে সুন্দরবনের ৩৫০ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় প্যাগমার্ক পদ্ধতিতে জরিপ চালিয়ে ধন বাহাদুর তামাং ৩৬২টি বাঘ রয়েছে বলে জানান। ২০০৪ সালে জরিপে বাঘের সংখ্যা ছিল ৪৪০টি। ১৯৯৬-৯৭ সালের জরিপে বাঘের সংখ্যা ৩৫০টি থেকে৪০০টি উল্লেখ করা হয়। ওই সময়ে বাঘের পায়ের ছাপ পদ্ধতিতে গণনা করা হয়। ২০১৫ সালের জরিপে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে বাঘের সংখ্যা আশংকাজনক হারে কমে দাঁড়ায় ১০৬টিতে। হঠাৎ করে সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা ৪০০টি থেকে ১০৬ টিতেএসে দাঁড়ালে সারা বিশ্বে হইচই পড়ে যায়। ২০১৮ সালে সর্বশেষ জরিপে বাঘের সংখ্যা ১১৪ টি। কিন্তু পূর্ব সুন্দরবনে ২০১৯ সালের ২১ আগস্ট থেকে ২০২২সালের ২৮ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রায় আড়াই বছরের ব্যবধানে ৪ টি বাঘের মৃত দেহ উদ্ধার করে বনবিভাগ। অপরদিকে ২০২১ সালের ১৯ জানুয়ারি পাচারকালে ১ টি বাঘের চামড়া সহ এক পাচারকারীকে আটক করে র্যাব-৮ ও বনবিভাগ। পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জ থেকে বাঘের একটি মৃতদেহ উদ্ধার করে বন বিভাগ এবং র্যাব-৬ একই রেঞ্জ থেকে চলতি বছরে একটি বাঘের চামড়া উদ্ধার করে। এ হিসাব থেকে কমে গেল ৭টি বাঘ। এ মুহূর্তে সুন্দরবনে কয়টি বাঘ আছে তার সঠিক হিসাব নেই বনবিভাগের কাছে। ২০২৪ সালের জুন মাসের দিকে বাঘ গণনার ফলাফল ঘোষণা করা হবে বলে জানা গেছে।
গবেষণার সহলেখক এবং প্যানথেরা টাইগার প্রোগ্রামের পরিচালক অভিষেক হরিহর বলেছেন, বাংলাদেশ এমন একটি দেশ, যেখানে আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং বিজ্ঞানীদের অবশ্যই মনোযোগী হতে হবে।

 

Please follow and like us:

Check Also

শ্যামনগরে পানি, স্যালাইন ও তরমুজ বিতরণ জামায়াতের

হুসাইন বিন আফতাব, নিজস্ব প্রতিবেদক:তীব্র তাপদাহ থেকে জনসাধারণকে স্বস্তি দিতে সাধারণ মানুষের মাঝে বোতলজাত পানি, …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।