সাতক্ষীরায় আশঙ্কাজনক হারে কমেছে কৃষি জমি

আবু সাইদ বিশ্বাস,সাতক্ষীরাঃ সাতক্ষীরায় আশঙ্কাজনক হারে কমছে ফসলি জমি। দুই দশকে জেলায় প্রায় সাড়ে আট হাজার কৃষি জমি কমেছে। বাড়তি জনসংখ্যার চাপ, অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষ, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, জলাশয় ভরাট সর্বপরি সরকারের কার্যকরি উদ্যোগ না থাকায় দিনের পর দিন ফসলি জমি হ্রাস পাচ্ছে। প্রতিনিয়ত বসতবাড়ি নির্মাণ, ইটভাটা, মৎস্য ঘের, কাঁকড়া খামার ও বিভিন্ন অপরিকল্পিত প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হচ্ছে কৃষি জমিতে। ইতোমধ্যে জেলার প্রায় ৩৮ দশমিক ১৩ ভাগ কৃষি জমি মাছ চাষের আওতাভুক্ত হয়ে পড়েছে। এছাড়া জলাবদ্ধতা কবলিত হয়ে পড়েছে মোট কৃষি জমির ১১ দশমিক ৫৪ ভাগ। এসব কারণে কমছে কৃষি জমি ও কৃষি ভিত্তিক খানার সংখ্যা। এর সাথে যুক্ত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, উজানের পানি প্রবাহ বন্ধ হওয়া ও অপরিকল্পিতভাবে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক বাস্তবায়িত হাজার হাজার প্রকল্প। যা কৃষি জমি কমে যাওয়ার বিষয়টিকে আশংকাজনক পর্যায়ে উন্নীত করেছে।
২৩ লক্ষ মানুষের বসবাসরত জেলাটিতে কৃষির সঙ্গে যুক্ত ৫ লাখ ১৪ হাজার ৩৬৬টি পরিবার। যেখানে ২০০৮ সালে কৃষির সঙ্গে যুক্ত ছিল ৪ লাখ ৩৬ হাজার ১৭৮টি পরিবার। ২০০১ সালে জেলায় চাষযোগ্য কৃষি জমি ছিল এক লাখ ৭৩ হাজার ৬০৪ হেক্টর; ২০১০-১১ সালে সেটি দাঁড়ায় এক লাখ ৭০ হাজার ৪১৯ হেক্টরে। ২০২২-২৩ সালে সেই কৃষি জমির পরিমাণ আরও কমে দাঁড়ায় এক লাখ ৬৫ হাজার ২৪৫ হেক্টরে। জেলা পরিসংখ্যান অফিসের তথ্য বলছে, সাতক্ষীরা জেলায় প্রায় ২২ লাখ মানুষের বাস। কৃষির সঙ্গে যুক্ত ৫ লাখ ১৪ হাজার ৩৬৬টি পরিবার। ২০০৮ সালে কৃষির সঙ্গে যুক্ত ছিল ৪ লাখ ৩৬ হাজার ১৭৮টি পরিবার। কৃষি জমির পরিমাণ কমলেও কৃষির সঙ্গে যুক্ত পরিবার বেড়েছে। জেলায় ভূমিহীন বা প্রান্তিক কৃষক বেড়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পায়নের কারণে আশঙ্কাজনক হারে কৃষি জমি কমছে। কৃষি জমি বাঁচাতে তেমন কোনো পদক্ষেপ না থাকাও অন্যতম একটি কারণ।জানা গেছে, কৃষি জমি বাঁচাতে “কৃষি জমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইন” নামে একটি প্রস্তাবিত আইন ৭ বছর ধরে ঝুলে রয়েছে। সম্প্রতি আইনটির প্রাথমিক খসড়া (বিল) সবার মতামতের জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। আইনটিতে দেশের সব ধরনের জমির শ্রেণি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এতে কৃষি, মৎস্য, প্রাণিসম্পদ, আবাসন, নদী, সেচ, নিষ্কাশন, পুকুর, জলমহাল, মৎস্য এলাকা চিহ্নিত করে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
সাতক্ষীরা জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সরদার শরিফুল ইসলাম বলেন, “আবাসন ও শিল্পোন্নয়নের কারণে জেলায় কৃষি জমির পাশাপাশি জলাশায়ও কমে যাচ্ছে। পুকুরগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে। তবে আমরা শিল্প কারখানার ক্ষেত্রে ছাত্রপত্র দিলেও জোরালোভাবে দেখছি সেটা কৃষি জমি কিনা। যেখানে দুই ফসল হয় সেখানে কোনোভাবেই শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য ছাড়পত্র দিচ্ছি না।”সাতক্ষীরা জলবাযু পরিষদের সদস্যসচিব অধ্যক্ষ আশেক-ই-এলাহী বলেন, “গত কয়েক বছরে জেলার অনেক কৃষি জমি অকৃষি খাতে চলে গেছে। দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অসাধু ইটভাটা মালিকের তৎপরতা, অবকাঠামো নির্মাণ, কৃষিতে উৎপাদন কমে যাওয়া, লবণাক্ততা বৃদ্ধি- প্রভৃতি কারণে কৃষি জমি কমে যাচ্ছে।”ইটভাটা বা কৃষি জমিকে অকৃষি খাতে ব্যবহার করার অভিযোগ থাকলেও জেলা প্রশাসন বলছে, তারা এ বিষয়ে তৎপর। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বিষ্ণুপদ পাল বলেন, “কৃষি জমিতে ইটভাটা, পুকুর খনন বা মাছের ঘের তৈরির খবর জানা মাত্রই আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করি।”
শুক্রবার (১৮ আগস্ট) সাতক্ষীরা শহরের ম্যানগ্রোভ সভাঘরে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক আয়োজিত ‘কৃষি জমি সুরক্ষায় জনসংগ্রাম’ শীর্ষক এক জনমতামত সভায় এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। সভায় সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটির আহবায়ক এ্যাড. আজাদ হোসেন বেলালের সভাপতিত্বে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব ও বিশিষ্ট সাংবাদিক অ্যাড. আবুল কালাম আজাদ। বক্তব্য রাখেন দৈনিক দক্ষিণের মশাল সম্পাদক অধ্যক্ষ আশেক-ই-এলাহী, সনাক-সাতক্ষীরার সভাপতি হেনরী সরদার, সিনিয়র সাংবাদিক মিজানুর রহমান, মানবাধিকার কর্মী মাধব চন্দ্র দত্ত, জেলা গণফোরামের সভাপতি আলী নুর খান বাবুল, জেলা কৃষক লীগের সহসভাপতি আল মাহমুদ পলাশ। বক্তারা আরও বলেন, কৃষিজমি রক্ষায় সাতক্ষীরায় বিভিন্ন সময়ে তুখোড় আন্দোলন হয়েছে। আন্দোলন সংগ্রাম করে তাৎক্ষণিক কিছুটা সফলতা পেলেও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের অভাবে কৃষি জমি রক্ষায় প্রশাসন কখনো কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এ কারণে সাতক্ষীরা জেলার হাজার হাজার হেক্টর কৃষি জমিতে অপরিকল্পিতভাবে লবণ পানি ঢুকিয়ে সর্বনাশ করা হয়েছে। যা পরিবেশ-প্রতিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। হুমকির মুখে পড়েছে কৃষি প্রাণ বৈচিত্র্য। এজন্য কৃষি জমি রক্ষায় রাষ্ট্রকেই উদ্যোগী হতে হবে। সাতক্ষীরায় কৃষি জমি বিনষ্টের ক্ষেত্রে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে সরাসরি দোষারোপ করে জেলা গণফোরামের সভাপতি আলী নুর খান বাবুল বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের অপরিনামদর্শী কর্মকান্ডের কারণে সাতক্ষীরার ৫০ ভাগ কৃষি জমি কমে গেছে। এটা যেন দেখার কেউ নেই। এটা নিয়ে প্রচুর আন্দোলন সংগ্রাম হয়েছে। কিন্তু পলিসি মেকাররা ঘুমিয়ে থাকে।

Please follow and like us:

Check Also

সাতক্ষীরা সদরের আগরদাঁড়ীতে সড়ক দূর্ঘটনায় পিতা-পুত্র নিহত

স্টাফ রিপোর্টার: সদর উপজেলার আগরদাড়ী মাদ্রাসা সংলগ্ন এলাকায় কাঠবোঝাই ট্রলির তলায় পড়ে পিতা-পুত্র নিহত হয়েছে। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।