একতরফা নির্বাচন হলে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংকট বাড়বে

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন একতরফা হলে চলমান সংকট আরও ঘনীভূত হবে বলে মনে করছেন বিশিষ্টজনেরা। তারা বলেছেন, একতরফা নির্বাচন হলে দেশের অর্থনীতি সংকটে পড়বে। অনেক খাতে সমস্যা দেখা দেবে। ভবিষ্যৎ চিন্তা করে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন জরুরি।

সাংবাদিক মনির হায়দারের সঞ্চালনায় ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজের এই ওয়েবিনারে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল অব. এম সাখাওয়াত হোসেন, যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিস্টিংগুইশ প্রফেসর আলী রীয়াজ, গবেষক জিয়া হাসান আলোচনায় অংশ নেন।

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, আবার একটি একতরফা নির্বাচনে দিকে যাচ্ছে দেশ। সংকট থেকে উত্তরণের কোনো উপায় দেখছি না। ৯৬ সালে ব্যবসায়ীরা বড় ভূমিকা রেখেছিল। সংকট সমাধানে এগিয়ে এসেছিল। শিক্ষক সমাজ বড় ভূমিকা রেখেছিল।  আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি- আজকে এই বিভাজনের মাঝেও এমন একটা সরকার যদি মাঝখানে দিতে পারি, যেটা তত্ত্বাবধায়ক সরকার জাতীয় কিছু। এ ধরনের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়েই, এই ধরনের সিভিল সার্ভিসদের দিয়েই।

কিছু নড়চড় হবে, কিছু এদিক সেদিক হবে। তাহলে ভালো নির্বাচন করানো সম্ভব। এটা ৯১, ৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে প্রমাণিত হয়েছে।

ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে একটি সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সম্ভব নয়। ২৮ তারিখের পর ১০ থেকে ১৩ হাজার বিএনপি নেতাকর্মীদের নামে মামলা করা হয়েছে। শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অনেক নেতাকর্মী পলাতক রয়েছে। তাদেরকে যদি ৩০ তারিখে মনোনয়ন দাখিল করতে হয়, তাহলে তাদের জামিন পেতে হবে এবং মুক্ত হতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে যেটা অসম্ভব। ফলে আবারো একটি একতরফা নির্বাচন হতে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, আইনগতভাবে ৭ই জানুয়ারি আসলেই নির্বাচন হতে যাচ্ছে কিনা আমার প্রশ্ন রয়েছে। বিকল্প থেকে বেছে নেয়াই হলো নির্বাচন। সেক্ষেত্রে বিকল্পটা হতে হবে যথার্থ এবং স্বাধীনভাবে বিকল্প বেছে নেয়ার সুযোগ থাকতে হবে। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুটি বড় দল। এই দল দুটি যদি নির্বাচনে না থাকে তাহলে বেছে নেয়ার সুযোগ থাকে না।  কারণ বাকি দলগুলো একে অপরের যথার্থ প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। যেহেতু বেছে নেয়ার সুযোগ থাকবে না, সেহেতু আইনগতভাবে নির্বাচন বলা যাবে কিনা প্রশ্ন রয়েছে।

বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচন মানেই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। একতরফা নির্বাচন কিন্তু সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নয়। ফলে নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক ম্যান্ডেট এতে পূরণ হবে না। তিনি বলেন, একটি পত্রিকায় বলা হয়েছে, রাজনৈতিক হয়রানির দায় নেবে না নির্বাচন কমিশন। তারমানে এখন  যে ধরপাকড়, মামলা-হামলা, গ্রেপ্তার করার জন্য একটি অনুমতি দিয়ে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। তাহলে তো বিরোধী দল সম্পূর্ণ মাঠছাড়া হয়ে যাবে। কারাগারে নেয়া হবে, পলাতক থাকবে। এই অবস্থায় নির্বাচনী মাঠ চরমভাবে অসমতল হয়ে যাবে। এখন তো সবকিছু নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারে চলে এসেছে। এরপরও যদি নির্বাচন কমিশন অনুমতি দিয়ে দেয়, তাহলে মাঠটা আরও প্রশমিত হয়ে যাবে। পত্রিকায় নিউজ হয়েছে-একদিনেই ১০৬ জন বিএনপি নেতাকে সাজা দেয়া হয়েছে। এতে নির্বাচনী মাঠটা অনেক বেশি অসমতল হয়ে গিয়েছে। কমিশন যদি রেফারি হিসেবে এই দায়িত্বটা পালন না করে, তাহলে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বটা কী? ইসি যদি দায় না নেয় তাহলে দায়টা কে নেবে? তাহলে ইসি’র কাজটা কী? তাদের কাজ কি ক্ষমতাসীনদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা?

বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের পর সরকারের গ্রহণযোগ্যতার সমস্যা দেখা দিয়েছে। আবারো একতরফা নির্বাচন হলে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা দূর হবে না। আন্তর্জাতিক চাপ আগে তেমন না থাকলেও এবার বেড়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে। একতরফা নির্বাচন হলে এই চাপ আরও বেড়ে যাবে। ভবিষ্যতে নিষেধাজ্ঞাও আসতে পারে এবং এগুলো সামাল দেয়া সহজ হবে না। বর্তমানে আমাদের অর্থনৈতিক সংকট রয়েছে। তৈরি পোশাক শিল্পের অস্থিরতা এই অর্থনৈতিক বিপর্যয়কে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ডলার সংকটের কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান কাঁচামাল আমদানি করতে পারছে না। এগুলোর ফলাফল আগামী দিনে ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।

এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, আপনাকে মনে রাখতে হবে বাংলাদেশে এখন যে অবস্থা চলছে, যখন আইয়ুব খানও অনির্বাচিত হয়ে একটি আজব ধরনের নির্বাচন দিয়েছিলেন। আইয়ুব খানের শাসনামলে স্কুল-কলেজে লেখাপড়া করেছি। ইউনিভার্সিটিতে পড়েছি, সেনাবাহিনীতে গিয়েছি। তারপর পাকিস্তান আমলে আরেকটি সামরিক শাসন এলো। বাংলাদেশের স্বাধীনতার লক্ষ্য ছিল- গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র তৈরি করা। সেই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র তৈরি হয় নাই। ’৭৩ সালে নির্বাচনী একটি আইন তৈরি করা হয়েছিল। এরপর সামরিক শাসন আসে। পরবর্তীতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া আসছিল; সেই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ফলাফল হলো বর্তমান পরিস্থিতি। এখন আমার পক্ষে বলা কঠিন, কোনটি ভালো। এরশাদের সময় তাকে বিশ্ববেহায়া আর গালিগালাজ করা হলেও কাউকে উঠিয়ে নেয়া হয়নি। তিনি বলেন, বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশন বেশিরভাগ সময় কোয়েশ্চেনেবল ছিল। যারা দায়িত্বে আসেন তাদের কমিটমেন্ট অনেক কম। দুয়েকটি নির্বাচন কমিশন ছাড়া বাকিগুলো ফাংশন করতে দেখা যায়নি। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আমার যোগাযোগ ভালো ছিল। এখন আর যোগাযোগ করি না। কারণ উনাদের হাব-ভাব দেখে আমি বুঝে গেছি- তাদের দ্বারা হবে না। তিনি বলেন, নির্বাচন হয়ে যাবে। আমি দেখি না সরকার কোনো ছাড় দেবে। কিন্তু  হোয়াট ইজ নেক্সট। অর্থনীতি ভেঙে পড়বে।

তিনি বলেন, আগে কখনো শুনিনি তিন গোয়েন্দা প্রধান উপযাচিত হয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছেন। নির্বাচন কমিশন ওপেন ফোরাম। সেখানে গোপন বৈঠক বলে কিছু হয় না। বৈঠক করলে পুরো কমিশনের সঙ্গে করতে হয়। ব্যক্তিগত ছাড়া একা এ ধরনের বৈঠক হয় না।

প্রফেসর আলী রীয়াজ বলেন, আমি তিনটি কথা বলতে চাই। প্রথম কথা হচ্ছে এই যে, একতরফা নির্বাচন হলে কী হবে। একটি হচ্ছে বৈধতার সংকট। এর পরিণতি কী। নৈতিক শক্তির অভাব তৈরি হয়। অভ্যন্তরীণ কিছু সংকট তৈরি হয়। দেশের বাইরের সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিছু সংকট তৈরি হয়। অভ্যন্তরীণ সংকট হলো- এক ধরনের নিয়ন্ত্রণহীনতা প্রতিষ্ঠিত হয়। যে প্রতিষ্ঠানগুলো সাজানো নির্বাচন করে তারা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে। একটা সুবিধাভোগী শ্রেণি সৃষ্টি হয়। এতে দারিদ্র্য বাড়ে, বৈষম্য বাড়ে। বাংলাদেশের বৈষম্য বেড়েছে। এই অর্থনীতির ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে বাংলাদেশ ঠেকেছে। কারণ তাদেরকে দেয়া হয়েছে অবারিতভাবে অর্থ। একটা নৈতিক বৈধতাহীন সরকার ঠিকে থাকতে হলে কী করবে।  যে চায় তাকেই অর্থ দেবে। যে প্রতিষ্ঠান চায় তাকে প্রতিষ্ঠান দেবে, যে ক্ষমতা চায় তাকে ক্ষমতা দেবে। দিতেই হবে। এবং দিয়েছে। ২০১৪ সাল থেকে সেটাই হয়েছে। একতরফা নির্বাচন হলে এটা অব্যাহত থাকবে। অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছে কারণ টিকে থাকার জন্য তাদের তোয়াজ করতে হয়েছে। তোয়াজ করা ছাড়া তাদের কোনো উপায় নেই। ক্ষমতার বৈধতার সংকট হলো নৈতিকতার সংকট।

অধ্যাপক আলী রিয়াজ বলেন, বাংলাদেশের তিন গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান সিইসি’র সঙ্গে দেখা করেছেন। তারা তাদের মতো করে বলেছেন কী করতে হবে। নিশ্চয় তারা এটাই বলতে গেছেন। এর বাইরে আর কী আলোচনা হতে পারে?

Please follow and like us:

Check Also

হাসপাতালে মোবাইলের আলোয় অস্ত্রোপচার, মা-নবজাতকের মৃত্যু

বিদ্যুৎ না থাকায় অপারেশন থিয়েটার অন্ধকার। নেই জেনারেটর বা বিকল্পব্যবস্থাও। যে কারণে কোনো লাইটই জ্বলছে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।