আজ ৬ জুলাই রোববার। ২০২৪ সালের ৬ তারিখ ছিল শনিবার। আগের দিন শুক্রবারের ধারাবাহিকতায় এদিনও কর্মসূচি অব্যাহত রাখে শিক্ষার্থীরা। জুলাই মাসের ৬ষ্ট দিনে আন্দোলনের কলেবর বৃদ্ধি পায়। মিছিল মিটিংগুলোতে উপস্থিতি বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে জনসমর্থন। ঢাকা থেকে ঘোষিত আন্দোলন সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পালিত হতে থাকে। তবে সরকারের মন্ত্রী এমপি ও ছাত্রলীগের হুমকি অব্যাহত থাকে। আশঙ্কার বিষয় হলো যে, ছুটির দিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকার বিষয়টি কাজে লাগিয়ে ফ্যাসিস্ট সরকারের সুবিধাভোগীরা আন্দোলন স্থিমিত করে দেওয়ার আশঙ্কায় নেতৃস্থানীয় ছাত্র নেতারা গণসংযোগ এবং জনসংযোগ অব্যাহত রাখেন। কর্মীদের চাঙ্গা রাখার জন্য কর্মসূচি অব্যাহত রাখেন। ছুটির দিনগুলোর সুবিধা নিয়ে সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আন্দোলন থামানোর চেষ্টা করে। ছাত্র নেতাদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করতে থাকে। এরপরও শিক্ষার্থীরা আন্দোলন অব্যাহত রাখার ব্যাপারে অটল থাকে।
৬ জুলাই শনিবার দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আগের দিনের মতোই বিক্ষোভ ও অবরোধ কর্মসূচি পালন করা হয়। এই আন্দোলনগুলো মূলত অহিংসভাবে পালন করা হয়। এ সময় আন্দোলনকারীরা সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন, ছাত্রধর্মঘট এবং সারা দেশে সড়ক-মহাসড়ক অবরোধের ডাক দেন। যার নাম দেওয়া হয় বাংলা ব্লকেড। বাংলাদেশের আন্দোলন সংগ্রাম মূলত ‘বাংলা ব্লকেড’ নামের একটি কর্মসূচি পায়। এই নাম আন্দোলনপ্রিয় মানুষের কাছে তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। মানুষের মুখে মুখে বাংলা ব্লকেড উচ্চারিত হয় বেশ কিছু দিন। পরবর্তীতে আন্দোলনকারীরা এই নামে কর্মসূচি দেওয়া শুরু করে। ৬ তারিখ ঘোষণা দেওয়া কর্মসূচি ৭ জুলাই থেকে অবরোধ কর্মসূচি শুরু হয়।
‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি ঘোষণার আগের রাতে অর্থাৎ ৫ তারিখ রাতে কার্জন হলের হোয়াইট হাউসের সিঁড়িতে বসে আন্দোলনের সংগঠকরা বৈঠক করে ‘বাংলা ব্লকেড’ নাম চূড়ান্ত করেন। এই কর্মসূচি কীভাবে সফল করা যায়, কোন কোন পয়েন্টে কোন কোন প্রতিষ্ঠান থাকবে, কোন পয়েন্টে কোন হল থাকবে, তা নিয়েও সেখানে আলোচনা হয়। বৈঠক থেকে প্রতিটি হলের প্রতিনিধিদের দায়িত্বও ভাগ করা হয়।
এদিন বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরা আগের দিনের সূচি অনুযায়ী কর্মসূচি চালিয়ে যেতে থাকে। সিদ্ধান্ত ছিল নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে যদি কেউ গ্রেফতার হয় কিংবা ভিন্ন কোন কারণে অন্য বক্তব্য দেয় বা আহত বা নিহত হয় তাহলে অন্যরা নেতৃত্ব দিবে। তবে কোনভাবেই আন্দোলন শেষ করার সুযোগ ছিল না। আন্দোলন চলবে এবং মাঠে যারা আছে তাদের সাথে আলোচনা করে গতিপথ এগিয়ে নিতে হবে।
মিছিলে বিগত দিনের চেয়ে নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল কয়েকগুণ বেশি। হাজার হাজার শিক্ষার্থীর স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে শাহবাগের আশপাশের এলাকা। এ সময় আন্দোলনকারীরা ‘কোটা না মেধা-মেধা মেধা’, আপস না সংগ্রাম-সংগ্রাম সংগ্রাম’, ‘আঠারোর পরিপত্র-পুনর্বহাল করতে হবে’, ‘কোটাপ্রথা নিপাত যাক, মেধাবীরা মুক্তি পাক’, ‘সারা বাংলায় খবর দে, কোটাপ্রথার কবর দে’, ‘আমার সোনার বাংলায়-বৈষম্যের ঠাঁই নাই’, ‘জেগেছে রে জেগেছে, ছাত্রসমাজ জেগেছে’, ইত্যাদি স্লোগান দেন।
‘শুধু শাহবাগ মোড় নয়, চানখাঁরপুল মোড়, মতিঝিল, নীলক্ষেত, সায়েন্সল্যাব মোড়- প্রতিটি পয়েন্টে আপনারা নেমে আসবেন এবং বাংলা ব্লকেড কর্মসূচি সফল করবেন। ঢাকার বাইরে শিক্ষার্থীরা জেলায় জেলায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে মহাসড়ক অবরোধ করবেন’ বলেন ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী নাহিদ ইসলাম।
ছাত্রলীগের উদ্দেশ্যে নাহিদ বলেন, ‘আমরা শুনেছি হলে হলে ছাত্রলীগের পদপ্রত্যাশীরা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে বাধা দিচ্ছে। তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, আমরা হলের তালা ভাঙতে জানি। তিনি বলেন এই আন্দোলন সারা বাংলার শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এরই মধ্যে তা প্রমাণ করেছে। আমরা সুযোগের সমতা চাই। আমরা চাকরিতে সমতা চাই। এটা কি আমাদের অপরাধ?
কর্মসূচি ঘোষণার আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, এতো দিন পুলিশ আমাদের সহযোগিতা করে এসেছে। কিন্তু আজকে পুলিশের একটি সুবিধাবাদী গোষ্ঠী আমাদের ভুয়া বলে সম্বোধন করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আঙুল উঁচিয়ে কথা বলেছে। আমার দিকে তেড়ে এসেছে। তিনি বলেন, পুলিশের সঙ্গে আমাদের যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে, সেটি উপেক্ষা করে সুবিধাবাদী কোনো গোষ্ঠী যদি কোনো ফায়দা লোটার চেষ্টা করে তাহলে আমরা তাদের হাত গুঁড়িয়ে দেব।
সরকারি চাকরিতে কোটা পুনর্বহালের প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) শিক্ষার্থীরা। টানা ষষ্ঠ দিনের মতো এ কোটাবিরোধী আন্দোলন করেন তারা। এদিন বিকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করেন শিক্ষার্থীরা। এরপর মিছিলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো প্রদক্ষিণ করে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এসে শেষ হয়। মিছিল শেষে একটি সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করেন আন্দোলনকারীরা।
ঢাকা ও ইডেন কলেজের শিক্ষার্থীরা নীলক্ষেত-সায়েন্সল্যাবে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জিরো পয়েন্টে এবং বোরহানুদ্দীন কলেজের শিক্ষার্থীরা চানখাঁরপুলে ব্লকেড কর্মসূচি পালন করবে। এদিকে আন্দোলনকারীরা চিন্তা করেন যে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আন্দোলনে যুক্ত হয়েছে তাদের সবাইকে শাহবাগে নিয়ে আসার প্রয়োজন নেই। ইতোমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সমাগমও যথেষ্ট বড় হচ্ছিল।
ওইদিন বিকাল সোয়া তিনটার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি ক্যাম্পাসের শ্যাডো ও মল চত্বর প্রদক্ষিণ করে মাস্টারদা সূর্যসেন হল ও হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের সামনে দিয়ে স্মৃতি চিরন্তন চত্বর, টিএসসি ও বকশী বাজার হয়ে বুয়েট ক্যাম্পাসের ভেতর দিয়ে পলাশী ও আজিমপুর এলাকা ঘুরে ফের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ভেতর দিয়ে শাহবাগ মোড়ে এসে বিক্ষোভ করেন।
এর আগেই আন্দোলনকারীদের একটি অংশ শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনের সড়কে মূল মিছিল আসার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। মূল মিছিলটি চারুকলা অনুষদের সামনে আসতেই জাদুঘরের সামনে অপেক্ষমান শিক্ষার্থীরা ৪টা ৩৭ মিনিটে শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন। এরপর তারা বিভিন্ন স্লোগান দিয়ে ৫০ মিনিট এ অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন।
একই দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সবগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটাবিরোধী শিক্ষার্থী ও চাকরি প্রত্যাশীরা বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেন। এর পাশাপাশি বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা ঢাকা, টাঙ্গাইল, রাজশাহী, রংপুর, কুষ্টিয়া ও চট্টগ্রামে সড়ক ও মহাসড়ক অবরোধ করেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে। অবরোধে ২নং গেট সড়কে দীর্ঘ সময় ধরে যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল। শনিবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা বিকাল ৩টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে আন্দোলন শুরু করে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) কোটা সংস্কার আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে শহর পর্যন্ত। সেখান থেকে শাটলে করে শহরে এসে মিছিল করতে করতে ষোলশহর স্টেশন থেকে ২নং গেটের দিকে যায় আন্দোলনকারীরা। ষোলশহর স্টেশন থেকে মিছিল ২নং এর দিকে যাওয়ার সময় পুলিশ বাঁধা দিলে তা উপেক্ষা করে এগিয়ে যায় আন্দোলনকারীরা।
প্রকৃতপক্ষে জুলাই আন্দোলন ছিল কোটার পাশাপাশি রাষ্ট্র সংস্কারের। কারণ রাষ্ট্রের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে তখন দূর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছিল। এই আন্দোলনে অভিভাবক সমাজ, রিক্সা শ্রমিক, ফেরিওয়ালা, পোশাক শ্রমিক থেকে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ সামিল ছিলেন।
দাবি ছিল কোটা সংস্কার করে ন্যায্যতার ভিত্তিতে সরকারী চাকুরীতে নিয়োগ এবং রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অক্টোপাসের মতো লেগে থাকা বৈষম্য দূর করা। কিন্তু সেটা না করে শিক্ষার্থীদের নানা ট্যাগ দেওয়া এমনকি রাজাকার সম্বোধন করা, ড্রাগ এডিকটেড বলে তিরস্কার করা, ছাত্রলীগ-যুবলীগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে শিক্ষার্থীদের হত্যা করা, মিথ্যা মামলা দিয়ে দমন নিপীড়ন করায় সবার সমর্থন আরও বাড়তে থাকে। এবিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে যতগুলো সিদ্ধান্ত আসতে থাকে আর শিক্ষার্থীরা তার বিরোধীতা করতে থাকে। আন্দোলনের গতি তীব্রতা লাভ করতে থাকে। সবচেয়ে মজার বিষয় ছিল পুরো প্ল্যান মাফিক আন্দোলনের গতি ধীরে ধীরে নো রিটার্ন অবস্থার দিকে যেতে থাকে। বিশেষ করে শেখ হাসিনা এবং তার অপরিপক্ক মন্ত্রীরা যখন-ই উত্তেজনাকর বক্তব্য দিতো তাতে আন্দোলনের গতিতে ঘি ঢালার পরিস্থিতি তৈরি হতে থাকে এবং আন্দোলনের ক্ষিপ্রতা বৃদ্ধি পেতে থাকে।
সরকার ভেবেছিল শিক্ষার্থীরা এক-দুইদিন আন্দোলন করবে এবং ক্লান্ত হয়ে থেমে যাবে। সরকার জানে না যে এর পেছনে কারা কাজ করছে। সিদ্ধান্ত হয় আপাতত শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চলবে। শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে বলা হয় যে, আমাদেরকে যদি বাধ্য করা হয়, আমরা প্রয়োজনে সারা দেশে হরতালের মতো কর্মসূচি দেব। ছাত্ররা বলেছিল ছাত্র সমাজকে আদালতের মুখোমুখি করা হচ্ছে, এ দায় নির্বাহী বিভাগ এড়াতে পারে না।