সাতক্ষীরায় ড্রাগন ফল চাষ সম্ভাবনার দ্বার খুলছে

আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরা:  জেলায় ড্রাগন ফলের বাজার চাহিদা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে কৃষি খাতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন হচ্ছে। ফলটি শুধু স্বাদ ও সৌন্দর্যেই নয়, পুষ্টিগুণ, কৃষকের আয় বৃদ্ধি এবং দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। গুণে ও মানে সেরা স্বাদের এ ফলটি মূলত মধ্য আমেরিকা ও মেক্সিকো অঞ্চলে উৎপন্ন হলেও বর্তমানে ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে। দুই দশক আগেও বাংলাদেশে এ ফল আমদানি করা হতো। মাটি ও আবহাওয়া ফলটি চাষের উপযুক্ত হওয়ায় ২০০৭ সাল থেকে দেশে ফলটি চাষাবাদ শুরু হয়। এক একর জমিতে ড্রাগন ফল চাষ করে কৃষকরা লাভবান হচ্ছে, বিধায় ফলটি এখন বাণিজ্যিকভাবে চাষ শুরু হয়েছে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে দ্রুত ফলটি রপ্তানিযোগ্য ফল হিসেবেও গুরুত্ব পাবে বলে আশা করছে সংশ্লিষ্টরা। প্রত্যন্ত জেলা সাতক্ষীরায়ও ফলটির চাষাবাদ বেড়েছে কয়েকগুণ। আগামী কয়েক বছরে জেলার অন্যান্য ফলের মধ্যে ড্রাগনও বড় একটা স্থান দখল করবে আশা চাষিদের। চলতি বছর জেলায় ২২ হেক্টর জমিতে ড্রাগন ফলের চাষ হয়েছে। গত বছর এ পরিমাণ ছিল ১৩ হেক্টর।
পুষ্টি বিজ্ঞানিদের মতে, ড্রাগন ফলের ১০০ গ্রামের মধ্যে ৫৫ গ্রাম থাকে ভক্ষণযোগ্য। প্রতি ১০০ গ্রাম ড্রাগন ফলে থাকে পানি ৮০ থেকে ৯০ গ্রাম, কার্বোহাইড্রেট ৯ থেকে ১৪ গ্রাম, প্রোটিন ০.১৫ থেকে ০.৫ গ্রাম, চর্বি ০.১ থেকে ০.৬ গ্রাম, আঁশ ০.৩ থেকে ০.৯ গ্রাম, অ্যাশ ০.৪ থেকে ০.৭ গ্রাম ও ক্যালরি ৩৫ থেকে ৫০। এছাড়া খনিজ ও ভিটামিনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো­ ক্যালসিয়াম ৬-১০ মিলিগ্রাম, আয়রন ০.৩-০.৭ মিলিগ্রাম, ফসফরাস ১৬-৩৬ মিলিগ্রাম, নায়াসিন ০.২-০.৪৫ মিলিগ্রাম, ভিটামিন সি ৪-২৫ মিলিগ্রাম, ক্যারোটিন ও রিবোফ্লাভিন থাকে খুব অল্প। লাল শাঁসের ড্রাগন ফলে ভিটামিন-সি থাকে বেশি। ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য ভাতের পরিবর্তে এ ফল উত্তম। তাইওয়ানের ডাক্তাররা ডায়াবেটিক রোগীদের ভাতের বদলে এ ফল খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এমনকি এ ফল রক্তে কোলেস্টরলের মাত্রা কমায় ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে। এ ফলের শাঁস পিচ্ছিল হওয়ায় তা কোষ্ঠকাঠিন্যও দূর করে।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, একটি এক বছরের গাছ ৩০টি পর্যন্ত শাখা তৈরি করতে পারে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ১২-১৮ মাস পর একটি গাছ ফল ধারণ করে। একটি ফলের ওজন ১৫০ থেকে ৬০০ গ্রাম। কখনো কখনো ফলের ওজন এক কেজি পর্যন্ত হয়। ফল তোলা শেষে প্রতিটি গাছের ৪০ থেকে ৫০টি শাখার প্রত্যেকটিতে ১ থেকে ২টি প্রশাখা রেখে বাকিগুলো ছেঁটে দিতে হবে। ছেঁটে দেয়ার পর ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হয়। একটি গাছে ৫ থেকে ২০টি ফল পাওয়া যায়। কিন্তু পূর্ণবয়স্ক একটি গাছে ২৫ থেকে ১০০টি ফল পাওয়া যায়। হেক্টর প্রতি ফলন ২০ থেকে ২৫ টন।
সাতক্ষীরার তালা উপজেলার ফলেরগ্রামে বাণিজ্যিকভাব ড্রাগন আবাদের উদ্যোক্তা অধ্যাপক তৌহিদুজ্জামান বলেন, এলাকার বেকার শিক্ষিত যুব সম্প্রদায়কে চাকরির বিকল্প হিসেবে কীভাবে লাভজনক কৃষিতে সমন্বয় করা যায়, তা নিয়ে চিন্তা শুরু করেন। একপর্যায়ে ইউটিউব দেখে ড্রাগনের প্রতি আকর্ষণ বাড়ে তার। প্রথমত, ২০২০ সালের দিকে তিনি নিজ এলাকায় ৭ বিঘা জমি বার্ষিক ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা লিজ নিয়ে ড্রাগন ফলের চাষ শুরু করেন। সফলতা পাওয়ায় পাশেই আরো ৫ বিঘা জমিতে ইজারা নিয়ে ড্রাগনের আবাদ সম্প্রসারণ করছেন। ড্রাগনের আবাদে সফলতা পাওয়ার পর অন্যদেরকেও উদ্বুদ্ধ করেন। এখন তাকে দেখে এলাকার অনেকেই ড্রাগনের আবাদ শুরু করেছেন এবং সাফল্যও পাচ্ছেন। প্রথম বছর সব মিলিয়ে ২৩ লাখ টাকা খরচ হয় তার। এরপর ফল আসার দু’বছরেই তিনি লগ্নিকৃত সমুদয় টাকা উত্তোলনের পর লাভের মুখ দেখেন। বর্তমানে প্রকল্পটি সম্পূর্ণ সফল। পরবর্তীতে ড্রাগন চাষের আধুনিক পদ্ধতির পাশাপাশি সারাবছর ড্রাগন চাষের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে অনুপ্রাণিত হন তিনি।
সাতক্ষীরার কলারোয়ার মাসুম হোসেন ২০২৪ সালে প্রায় ১৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে ১০ বিঘা জমির ওপর গড়ে তোলেন ড্রাগন ফলের বাগান। ইতোমধ্যে চার লাখ টাকার ফল বিক্রি করেছেন এবং পুরো মৌসুম শেষে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকার ফল বিক্রির আশা করছেন তিনি। কলারোয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এস এম এনামুল ইসলাম জানান, উপজেলায় ৫.৫ হেক্টর জমিতে ডিমরোজ জাতের ড্রাগন ফলের আবাদ হচ্ছে। প্রতি হেক্টরে প্রায় ২৩ মেট্রিক টন ফলন হয়। কৃষি বিভাগ নিয়মিতভাবে চাষিদের প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ মো. সাইফুল আলম বলেন, বিদেশি ফল ড্রাগন ভিটামিন সি, মিনারেল ও আঁশসমৃদ্ধ। পাঁচ বছর আগেও সাতক্ষীরা এটি সীমিত আকারে চাষ হয়েছে। বর্তমানে জেলার পাঁচটি উপজেলাতেই ব্যাপকভাবে ড্রাগন ফল চাষ হচ্ছে। উৎপাদন খরচ তুলনামূলক কম। তাই এতে লাভবান হচ্ছে কৃষকরা। আধুনিক ও পুষ্টিকর এ ফলের দাম ভালো পাওয়ায় কৃষকরাও ঝুঁকছে।

About news-admin

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *