রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে চীনা রাষ্ট্রদূতের মন্তব্যের সমলোচনা ঢাকায়

ক্রাইমবার্তা রিপোটঃ     ঢাকা: রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধান নিয়ে ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূতের মন্তব্যের সমালোচনা করেছেন বাংলাদেশী একজন কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক। ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত ঝাং ঝাও বুধবার ঢাকায় বলেছেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে রোহিঙ্গা সঙ্কটের সমাধান করা যেতে পারে। কিন্তু রোহিঙ্গা মুসলিমদের দুর্ভোগের সঙ্গে অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগকে এক সমান করে দেখানো মানবাধিকারের প্রতি অসম্মান বলে মনে করেন বাংলাদেশের শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবর্তন বিষয়ক কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম। তিনি বেনার নিউজকে শুক্রবার বলেছেন, শুধু ডেভেলপমেন্ট বা উন্নয়নের মাধ্যমে রোহিঙ্গা সঙ্কটের সমাধান হবে না। এক্ষেত্রে মিয়ানমার সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি আরো বলেছেন, রাখাইনে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অধিকার দেয়া না হলে এ সঙ্কটের শেষ হবে না। এ খবর প্রকাশিত হয়েছে অনলাইন রেডিও ফ্রি এশিয়া’তে।

বেনার নিউজ এ সময় আবুল কালাম আজাদ ও বাংলাদেশের অন্যদের কাছে জানতে চায়, চীনা রাষ্ট্রদূতের করা মন্তব্যের বিষয়ে।
চীনা রাষ্ট্রদূত বেইজিংয়ের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড ইনিশিয়েটিভের বিষয়ে বুধবার ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখছিলেন। এ সময় তিনি বলেন, এ বিষয়ে প্রকৃত সমাধান রয়েছে উন্নয়নের মধ্যে। তিনি ২০১৭ সালের আগস্টে সেনাবাহিনীর নৃশংসতার ফলে বাধ্য হয়ে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়া কমপক্ষে ৭ লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গার প্রসঙ্গে এসব কথা বলেন। চীনা রাষ্ট্রদূত আরো বলেন, আমরা আশা করি, সহিংসতা থেমে যাওয়ার পরে লোকজনকে ফেরত পাঠানো হবে। রাখাইন রাজ্যকে আরো উন্নত করা যেতে পারে। আমরা আরো আশা করি, বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডোর বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমরা রোহিঙ্গা সমস্যার একটি চমৎকার সমাধান পাবো।
বিসিআইএম হলো বাংলাদেশ-চায়না-ভারত-মিয়ানমার আঞ্চলিক সহযোগিতা ফোরাম। এশিয়ার চারটি দেশের মধ্যে বাণিজ্য উন্নত করার জন্য ১৯৯০ এর দশকের শুরুর দিকে এ ধারণার শুরু। চীনা রাষ্ট্রদূত বিস্তারিত কিছু বলেন নি। তবে তিনি বলেছেন, চীন প্রস্তাবিত সার্বিক সমাধানের একমাত্র অংশ হলো প্রত্যাবর্তন।

যেমন প্রস্তাব করা হয়েছিল, বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডোর সংযুক্ত করবে দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের ইউনান প্রদেশের রাজধানী কুনমিংকে কলকাতার সঙ্গে। এই সংযুক্তি ঘটবে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা ও মিয়ানমারের দ্বিতীয় বৃহৎ শহর মান্দালয় হয়ে। অলাভজনক থিংক ট্যাংক বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সভাপতি মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) এএনএম মুনিরুজ্জামান বলেছেন, চীনা রাষ্ট্রদূত এই বার্তাই দেয়ার চেষ্টা করেছেন যে, প্রস্তাবিত বিসিআইএম করিডোর যাবে রাখাইন রাজ্যের ভিতর দিয়ে। তাই বিসিআইএম করিডোর বাস্তবায়নের পূর্বশর্ত হলো রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধান। চীনা রাষ্ট্রদূতের ব্রিফিংয়ে উপস্থিত ছিলেন মুনিরুজ্জামান। তিনি বলেছেন, দৃশ্যত চীন রোহিঙ্গা সঙ্কটকে দেখছে বেইজিংয়ের জাতীয় স্বার্থের ভিত্তিতে। রাখাইনের গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে চীন। তারা সেখানে একটি এনার্জি টার্মিনাল নির্মাণ করছে। কিন্তু শুধু উন্নয়নই রোহিঙ্গা সঙ্কটের একমাত্র কৌশল হতে পারে না।
নভেম্বরে মিয়ানমার চীনের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সিআইটিআইসি গ্রুপের সঙ্গে একটি নতুন চুক্তি স্বাক্ষর করে। এ চুক্তির অধীনে রাখাইন রাজ্যের কাইউক পাইউ গভীর সমুদ্র বন্দরে মাল্টি বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের মাধ্যমে উন্নয়ন করতে চেয়েছে। এই চুক্তিটি এসেছে, কারণ মিয়ানমার বেইজিংয়ের খুব কাছাকাছি অবস্থান নিয়েছে।
বিশ্লেষক ও শিক্ষাবিদরা চীনা কূটনীতিকের মন্তব্যকে দেখছেন এভাবে যে, বেইজিং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিষয়টি দেখছে অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রফেসর দেলোয়ার হোসেন বলেছেন, উন্নয়নের নিরীখে মানবাধিকারকে অবজ্ঞা করে চীন রোহিঙ্গা সঙ্কটের সমাধান দেখছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক তদন্তকারীরা মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জাতি নির্মূলের অভিযোগ এনেছেন। বলা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে দমনপীড়ন চালানোর সময় এসব মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে মধ্যস্থাতার প্রস্তাব দিয়েছে বেইজিং। কিন্তু রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে সমঝোতা প্রক্রিয়া থমকে আছে। এ বছর মার্চে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হক জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে বলেছেন, শরণার্থী সঙ্কট খারাপ থেকে আরো খারাপ হয়েছে। তিনি আরো বলেছেন, মিয়ানমার থেকে আসা শরণার্থীদের আর ধারণ করতে সক্ষম হচ্ছে না ঢাকা। বেসরকারি থিংক ট্যাংক সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন প্রশ্ন তুলেছেন চীনা রাষ্ট্রদূতের মন্তব্যের বিষয়ে। তিনি বলেন, চীন বলেছে তারা বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে উন্নয়ন দেখতে চায়। কিন্তু তারা রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন নিয়ে নীরবতা অবলম্বন করে যাচ্ছে। তিনি বলেন, মিয়ানমারকে সবার আগে নিরাপত্তা, মৌলিক অধিকার, মুক্তভাবে চলাচলের অধিকার, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের বিষয়টিতে নিশ্চিত করতে হবে, যাতে শরণার্থীরা ফিরে যেতে চান।

Please follow and like us:

Check Also

সাতক্ষীরা সদরের আগরদাঁড়ীতে সড়ক দূর্ঘটনায় পিতা-পুত্র নিহত

স্টাফ রিপোর্টার: সদর উপজেলার আগরদাড়ী মাদ্রাসা সংলগ্ন এলাকায় কাঠবোঝাই ট্রলির তলায় পড়ে পিতা-পুত্র নিহত হয়েছে। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।