ক্রাইমবার্তা রিপোটঃ সাতক্ষীরার নবাগত সিভিল সার্জনের যোগদান এবং সদ্য আত্মপ্রকাশের চেষ্টাকারী রাজনৈতিক কর্তৃত্ব কমে আসায় সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে রাজস্ব আদায় দ্বিগুন হয়েছে। হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগের বিভিন্ন রুমে রাজনৈতিক নেতাদের আত্মিয় স্বজনদের এখন আর আগের মত দেখা যাচ্ছে না। আবার একজন সৎ কর্মঠ সিভিল সার্জন সম্প্রতি যোগদান করেছেন। ফলে পরিস্থিতি পাল্টে যাওয়ায় বৃহৎ এই হাসপাতালে রাজস্ব আদায়ে এ যাবৎকাল কিভাবে ভাগবাটোয়ারা অনিয়ম দুর্নীতি আর চুরি হয়েছে তা সহজেই বুঝতে পারছে সকলে। সাতক্ষীরার সদ্য আত্ম প্রকাশের চেষ্টাকারী রাজনৈতিক গড়ফাদারের কতৃত্ব খর্ব হওয়ার পর চাঁদাবাজী ও দুর্নীতি কমে আসায় রাজস্ব আদায়ের এই তারতম্য পরিলক্ষিত হচ্ছে বলে অভিজ্ঞমহল মনে করেন।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন অফিসের কর্মরত থাকা অবস্থায় সাবেক সিভিল সার্জন ডা. রফিকুল ইসলাম চলতি বছরের এপ্রিল-মে ও জুন মাসে বহির্বিভাগ, আন্ত:বিভাগ ও জরুরী বিভাগে টিকিট বিক্রি, প্যাথলজি বিভাগ, এক্স-রে বিভাগ, ইসিজি বিভাগ, বেড ও কেবিন ভাড়া, অপরেশন বাবদ সংগ্রহ, আল্ট্রাসনো পরীক্ষা, সরকারি এ্যাম্বুলেন্স ভাড়া আদায় ও ইমাজেন্সি বিভাগে রাজস্ব আদায় করেছেন ১০ লাখ ৯৩ হাজার ৯৪৫ টাকা। আর ১১ জুলাই ২০১৯ বর্তমান সিভিল সার্জন ডা. শেখ আবু শাহীন যোগদান করে প্রায় আড়াই মাসে রাজস্ব আদায় করেছেন ২২ লাখ ৪৭ হাজার ৬২ টাকা। অর্থাৎ পূর্বের তিন মাসের চেয়ে কম সময়ে বর্তমান সিভিল সার্জন ১১ লাখ ৫৩ হাজার ১১৭ টাকা বেশি রাজস্ব আদায় করেছেন অতীতের সিভিল সার্জনের তুলনায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চলতি বছরের এপ্রিল মে ও জুন মাসে সিভিল সার্জন ডা. রফিকুল ইসলাম বহির্বিভাগ, আন্ত:বিভাগ ও জরুরী বিভাগে টিকিট বিক্রি বাবদ রাজস্ব আদায় করেছেন ২ লাখ ৯৩ হাজার ৯৮২ টাকা। এর পরের ৩ মাস অর্থাৎ জুলাই আগস্ট ও সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বর্তমান সিভিল সার্জন ডা. শেখ আবু শাহীন বর্হি আন্ত ও জরুরী বিভাগ থেকে টিকিট বিক্রি বাবদ রাজস্ব আদায় করেছেন ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৮২ টাকা। এখানে বর্তমান সিভিল সার্জনের সময়ে টিকিট বিক্রি বাবদ রাজস্ব আদায় বেড়েছে ৮৩ হাজার ১০০ টাকা।
পাশাপাশি সাবেক সিভিল সার্জন ডা. রফিকুল ইসলামের সময়ে এপ্রিল মে ও জুন মাসে প্যাথলজি বিভাগ থেকে রাজস্ব আদায় হয়েছে ২ লাখ ১০ হাজার ৬৩০ টাকা। পরবর্তী জুলাই আগষ্ট ও সেপ্টেম্বর ৩ মাসে বর্তমান সিভিল সার্জন ডা. শেখ আবু শাহিন প্যাথলজি বিভাগ থেকে রাজস্ব আদায় করেছেন ৭ লাখ ৫১ হাজার ৬৯০ টাকা। এখানে সাবেক সিভিল সার্জনের তুলনায় বর্তমান সিভিল সার্জন রাজস্ব আদায় বেশি করেছেন ৫ লাখ ৪১ হাজার ৬০ টাকা। একইভাবে এক্স-রে বিভাগে এপ্রিল মে ও জুন মাসে সাবেক সিভিল সার্জন রাজস্ব আদায় করেছেন ৩২ হাজার ৭৩০ টাকা। এরপর বর্তমান সিভিল সার্জন জুলাই আগষ্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে এক্স-রে বিভাগ থেকে রাজস্ব আদায় করেছেন ১লাখ ৭৭ হাজার ১৭৫ টাকা। এখানে ১লাখ ৪৪ হাজার ৪৪৫ টাকা বেশি রাজস্ব আদায় করেছেন বর্তমান সিভিল সার্জন ডা: শেখ আবু শাহীন। এভাবে প্রতিটি বিভাগেই রয়েছে রাজস্ব আদায়ের ব্যাপক ব্যবধান। আর রয়েছে ঘাপলা। এসব বিভাগে কর্মরত কর্মচারিরা এযাবতকাল অতি উৎসাহী হয়ে আনন্দের সাথে সদর হাসপাতালে চাকুরি করলেও এখন যেন এদের প্রাণ ওষ্ঠাগত! অনেকেই বলছেন অন্য জেলায় চলে যাই। আর চাকরি করার পরিবেশ এখানে নেই।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন কর্মচারি জানান, রাত ১০টা বাজে অফিস বন্ধ করে বেরিয়ে যাবো। সব মেশিন পত্র বন্ধ করছি। হঠাৎ দেখি সিভিল সার্জন স্যার দরজায় দাড়িয়ে আছেন। আবার খুলে বসতে হল। সেই রাতেই হিসাব নিকাস দেখিয়ে উঠতে হল। এভাবেই চলছে প্রতিনিয়ত রাজস্ব আদায়ে নানা কৌশল। সকাল থেকে ১২টা পর্যন্ত প্রতিদিন হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ড, প্যাথলজি, এক্স-রে, ইমেজিং, সিটি স্ক্যান ও জরুরী বিভাগে ঘুরে ঘুরে দেখছেন, সাধারণ মানুষের কথা শুনে সেসব সমস্যা সমাধানের তাৎক্ষণিক চেষ্টায় ইতোমধ্যে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে সেবার মান বেড়েছে অনেকটাই বলে মনে করেন রুগী ও তাদের স্বজনরা।
সূত্র জানায়, সদ্য আত্মপ্রকাশের চেষ্টাকারী রাজনৈতিক গডফাদারের আত্মীয় স্বজনদের এখন সিভিল সার্জন অফিস ও হাসপাতালে খুব একটা দেখা যায় না। ইতোপূর্বে তাদের অবাধ বিচরণ ছিল হাসপাতালে। তারা প্যাথলজি থেকে নিয়মিত মাসোহারা নিত। সেই সাথে দুর্র্নীতিবাজ কর্মকর্তা কর্মচারীরাও ভাগবাটোয়ারায় ব্যস্ত ছিল।
তবে এই অনিয়মের বিষয়ে সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ আনিসুর রহিম তার প্রতিক্রিয়ায় জানান, দীর্ঘ ৪/৫ বছরের বেশি সময় ধরে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে অনিয়ম দুর্নীতি বেড়েই চলেছে। এমনকি কোটি কোটি টাকার মেশিনপত্র কেনা হলেও মেশিন না আসলেও খাতা কলমে দেখিয়ে টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। এসব বিষয় নিয়ে জেলার গণমাধ্যমকর্মীরা হঠাৎ করে স্বোচ্চার হওয়ায় এসব দুর্নীতির প্রতিকারের বিষয়টি এখন দৃশ্যমান। একই সাথে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগ থেকে দীর্ঘদিন শুধু টাকা পয়সা চুরি নয়, মেশিনপত্রও চুরি করে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা আমাদের কানে আসে। কিন্তু কোন প্রতিকার আমরা পাইনা। তিনি রাজস্ব আদায়ে ব্যাপক ব্যবধান শুনে বলেন, এই ঘটনায় তদন্ত টিম গঠন করে কারা এসবের সাথে জড়িত তাদেরকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। তা না হলে বিষয়টি আন্দোলনের রুপ নেবে।
পাশাপাশি নাগরিক আন্দোলন মঞ্চ সাতক্ষীরার সভাপতি এড. ফাহিমুল হক কিসলু জানান, রাজস্ব আদায়ের যে ব্যবধান গণমাধ্যম কর্মীরা তুলে ধরছেন সে বিষয়টি খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এসব অনিয়মের সাথে যারা জড়িত তাদেরকে তদন্ত করে আইনের আওতায় আনার দাবীও জানান তিনি। একই সাথে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও এমন দুর্নীতি চলছে বলে মনে করেন। সেবিষয়টিও গণমাধ্যমে আসার আহবান জানিয়ে ফাহিমুল হক কিসলু বলেন, রেজিস্ট্রেশন ছাড়াই পরিকল্পিতভাবে জনগণের দেয়া অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে যারা পকেটস্থ করেছেন তাদেরকে আইনের আওতায় আনা জরুরী হয়ে পড়েছে। তা না হলে আন্দোলন করে তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হবে।
তবে এসব বিষয়ে বর্তমান সিভিল সার্জন ডা. শেখ আবু শাহীন বলেন, সরকারের নির্দেশ পালনের যথাযথ চেষ্টা করেছি। কতটা করেছি তা বলতে পারবো না। তবে চেষ্টা করেছি সেটি বলতে পারি।
Check Also
নির্বাচন সুষ্ঠু করতে যাহা কিছু করার প্রয়োজন তাই করা হবে: সাতক্ষীরায় নির্বাচন কমিশনার
শাহ জাহান আলী মিটন, সাতক্ষীরা: নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আহসান হাবিব খান বলেছেন, নির্বাচন …