চীন-ভারত টানাপোড়েনের আসল কারণ কি কারাকোরাম মহাসড়ক?

আবদুর রহমান: সাম্প্রতিক সময়ে কাশ্মীর সংলগ্ন লাদাখে চীন ও ভারতের তুঙ্গে ওঠা উত্তেজনার প্রতি উপমহাদেশের মানুষের তীক্ষ্ণ নজর। এরই মধ্যে একদফা গ্রাম্য কায়দায় লড়াই হয়ে গেছে এবং এতে ভারতীয় পক্ষের বড় ধরনের ক্ষতির কথা চাউর হয়ে গেছে। এখন প্রশ্ন হলো, এই বিবাদের আসল লক্ষ্যটা কি? নিছকই জমি নিয়ে বিরোধ? নাকি মূল লক্ষ্য কারাকোরাম মহাসড়ক? চীন চায় তার এই স্বপ্নের মহাসড়ক ভারতের থাবা থেকে নিরাপদ থাকুক। আর ভারত চায় এর কাছাকাছি পৌঁছে একে হুমকির মধ্যে ফেলে চীন ও পাকিস্তানকে চাপে রাখতে। কিন্তু কী নিয়ে এই বিবাদ?
এটি খুবই সাধারণ ও ন্যায়সঙ্গত অধিকার হতে পারে যে, যে যার আপন সীমান্তের বৈধ ভূমিতে নিজেদের পছন্দমত যে কোন ধরণের স্থাপনা নির্মাণ করবে। তাতে অন্যের বাধা-প্রতিবন্ধকতা তৈরির কী অধিকার আছে। কিন্তু প্রতিরক্ষা কৌশল এমনই এক বিষয় যা এই নায্যতা ও বৈধতার ধার ধারে না। ভবিষ্যত রাজনৈতিক, সামরিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থ সুরক্ষিত করতে তাই দেশগুলো নিজ নিজ কৌশল নির্ধারণ ও তা সফল করতে প্রয়াসী হয়। এর মধ্যে চলে প্রচুর দেনদরবার, চাপাচাপি, ঠোকাঠুকি আর নিজেদের ভাগে মাখনটুকু আদায় করে নেয়ার প্রচেষ্টা। এর সবকিছুই আম জনতার নজরে আসে- তা কখনোই হয় না। চীন, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান প্রভৃতি দেশ এই সময় সেই ধরণের একটা কৌশলের পাঁকে হাবুডুবু খাচ্ছে। এর তাজা উদাহরণ ‘লাদাখ’। লাদাখ কি শুধুই লাদাখের মধ্যে মধ্যে রয়েছে? নাকি এর সুদুরপ্রসারী লক্ষ্য রয়েছে? এই নিবন্ধের মূল আলোচ্য সেটিই।
কারাকোরাম মহাসড়ক প্রসঙ্গ
কারাকোরাম মহাসড়ক এমনই একটি করিডোর যা চীনের জন্য এক বড়রকম লাইফ লাইন হিসেবে পরিচিত। মানচিত্র লক্ষ করলেই বুঝা যায়, চীনকে ভারত মহাসাগর, আরব সাগর আর লোহিত সাগরের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ ও সুবিশাল জলভাগে প্রবেশ করতে হলে আকাশপথ ছাড়া স্থলপথের কোনোও বিকল্প নেই। একমাত্র বিকল্প তাকে পাকিস্তানের ভেতর দিয়ে দীর্ঘতম স্থলপথের ব্যবস্থা করা। বিষয়টি খুব স্বাভাবিক ছিল না। বলতে গেলে এরকম যে, পাকিস্তানের মাথা বা মুখ দিয়ে ঢুকে পুরো শরীর অতিক্রম করে পায়ুপথ বা লেজ দিয়ে বের হওয়ার মতো। চীনকে তাই সেই পথেই এগুতে হয়েছে। পাকিস্তানের মাথার উপরে চীনের প্রবেশপথ কারাকোরাম পর্বতমালা দিয়ে আবদ্ধ থাকায় সেই দুর্গম পাহাড় কেটে পথ তৈরি করতে হয়েছে। আর সেটিই হলো বহুল আলোচিত কারাকোরাম পাস ও মহাসড়ক।
অন্যদিকে পাকিস্তানের আরেক প্রান্তে করাচি বন্দর পর্যন্ত এই মহাসড়ক পৌঁছেছে। সেখান থেকে বেলুচিস্তানের গোয়াদর সমুদ্র বন্দরে পৌঁছানোর আয়োজন করা হয়েছে। করাচি ও গোয়াদর বন্দর আরব সাগরের পাড়ে হলেও তা একদিকে ভারত মহাসাগর এবং অন্যদিকে পারস্য উপসাগর ও লোহিত সাগরের দিকে পাড়ি দেয়ার পথ উন্মুক্ত। ফলে এই দুই বন্দর ব্যবহার করে চীনকে একই সঙ্গে শ্রীলঙ্কায় নির্মিত হাম্বানটোটা বন্দরের সঙ্গেও সংযোগ স্থাপন করতে সমর্থ হবে। এমনকি বঙ্গোপসাগরেও পৌঁছাতে পারবে। এই সঙ্গে চীন যে ‘ওয়ান রোড ওয়ানবেল্ট’ প্রকল্প নিয়ে বিশ^ বাণিজ্যপথ চালু করতে চলেছে এটি হবে তার অন্যতম একটি রুট। যে কারণে কারাকোরাম মহাসড়ক চীন ও পাকিস্তানের কাছে এতোটা গুরুত্বপূর্ণ।
বলা হচ্ছে, শতাব্দীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এক কারিগরি নিদর্শন এই মহাসড়ক। ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে সাড়া ফেলে দেয় এই মহাসড়ক উদ্বোধনের মধ্যে দিয়ে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রকৌশলীরাই পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে পথ কেটে বানিয়েছিলেন এই রাস্তা। সমুদ্রপৃষ্ঠ  থেকে অনেক ওপরে দুর্গম পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে ১৩০০ কিলোমিটারের এই পথ পশ্চিম চীনের কাশগরের সঙ্গে যুক্ত করেছিল পাকিস্তানের ইসলামাবাদকে। কারাকোরাম মহাসড়কের আরেক নাম চীনে ‘ফ্রেন্ডশিপ হাইওয়ে’। ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে শুরু হয়েছিল এই সড়ক তৈরির কাজ। খাড়া পাহাড় এবং দুর্গম পাহাড়ে কাজের কঠিন পরিবেশের মধ্যে এই পথ নির্মাণের কারণে কখনও কখনও একে বলা হয় বিশ্বের অষ্টম আশ্চর্য। কারাকোরাম পর্বতমালার মতো দুর্গম এলাকা বিশ্বে আর নেই বললেই চলে। এই পাহাড়ের ৬০টি শৃঙ্গ আছে। এগুলোর উচ্চতা গড়ে প্রায় ৬ হাজার ৬০০ মিটার। দুর্গম এই পাহাড়ে পথ তৈরি ছিল ১৯৬০-৭০’র দশকে বিরাট এক চ্যালেঞ্জ। হাইওয়ের মূল উদ্দেশ্য হিসেবে দুই দেশের মধ্যে কৌশলগত অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করার কথা বলা হলেও সামরিক ক্ষেত্রে এর খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা স্বীকার করা হয়। ভারত সীমান্তে সৈন্যবাহিনীর সামরিক যান ও পরিবহনের গতিশীলতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এটি ভারত থেকে তার নিয়ন্ত্রণাধীন বিতর্কিত অঞ্চলগুলিকে রক্ষা করতে পাকিস্তানের সক্ষমতা বাড়াবে। এই সড়কের সুদূর উত্তর দিকে বিরোধপূর্ণ কাশ্মীরের হিমালয় অঞ্চল অবস্থিত। এটিই একমাত্র রাস্তা যা দক্ষিণ পাকিস্তানি বন্দর গোয়াদরের সঙ্গে চীনকে যুক্ত করেছে।
১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে চীন-ভারত যুদ্ধ এবং ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে কাশ্মীরের ভূকৌশলগত অবস্থানে ব্যাপক পরিবর্তন হয়। এ কারণে শুধু পাকিস্তানই নয়, চীনও কাশ্মীর জটিলতায় সরাসরি যুক্ত হয়ে যায়। ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তান চীনকে ট্রান্স-কারাকোরাম ট্র্যাক (প্রায় ২ হাজার ৭০০ বর্গকিলোমিটার) দিয়ে দেয়। সীমানা সংশোধন এবং কারাকোরাম হাইওয়ে তৈরির প্রাক্কালে এই লম্বা টানা স্ট্রিপ চীনকে দেয়া হয়। মার্কিন সামরিক সাহায্য বন্ধ হলে পাকিস্তান এবং এর সামরিক বাহিনীর সঙ্গে ভূকৌশলগত, ভূরাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ককে উচ্চপর্যায়ে নিয়ে যায় চীন।
চীনের বিশাল স্বার্থ
বর্তমানে চীনের জন্য মধ্যপ্রাচ্যে এবং উত্তর আফ্রিকার জ্বালানি সঞ্চালনের প্রধান পথ হলো পাকিস্তান। অন্যদিকে নিকট বর্তমানের পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের হামাস আবদাল থেকে গিলগিট বাল্টিস্তানের খুলজেরাব গিরিপথ পর্যন্ত চীন ব্যবহার করে। কারাকোরাম মহাসড়ক চীনের জন্য ক্রমেই অর্থনৈতিক ও ভূকৌশলগত কারণে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হয়ে উঠেছে। এ কারণে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর রক্ষায় পাকিস্তান চীনের অর্থায়নে বিশেষ বাহিনী গড়ে তুলেছে। কারাকোরাম হাইওয়ে মোট ১ হাজার ৩০০ কিলোমিটার, যার ৮৮৭ কিলোমিটার পাকিস্তান অঞ্চলে এবং ৪১৩ কিলোমিটার চীনের মধ্যে রয়েছে। এই হাইওয়ে আরব সাগরের বন্দর গোয়াদরকে চীনের সিংজিয়াংয়ের সঙ্গে যুক্ত করার একমাত্র পথ। এখন পাকিস্তানে অ্যাবোটাবাদ হয়ে কাশগড় পর্যন্ত রেলওয়ে লাইনের সম্প্রসারণকাজ শুরু হয়েছে। এই প্রকল্পে দুই দেশ বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে চলেছে।
ভারত কী চায়?
এতো গেলো চীন-পাক প্রসঙ্গ। এখন ভারত কী চায়? কারাকোরাম পাসের অদূরবর্তী লাদাখ অঞ্চলে ভারত প্রচুর অবকাঠামো গড়ে তুলছে। এর মধ্যে চীন সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় নতুন করে তৈরি কিংবা সংস্কার করা হচ্ছে এমন সড়কের সংখ্যা ৬০-এর বেশি। মূলত লাদাখ থেকে ভারতে বিমানবাহিনীর একটি ঘাঁটি পর্যন্ত আড়াইশো কিলোমিটারের সড়ক নিয়েই চীন আপত্তি জানিয়ে আসছে। গত বছরের অক্টোবরে এই সড়কটির উদ্বোধন করেন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং। স্থানীয়দের জন্য এসব অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে বলে নয়াদিল্লি দাবি করলেও চীনের গণমাধ্যমগুলো সীমান্তে ‘উসকানি’র জন্য ভারতকে দায়ী করে আসছে। নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর ভারতের এসব অবকাঠামো নির্মাণে চীন তাই বারবার বাধা দিচ্ছে। কৌশলতভাবে লাদাখের গলওয়ান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
এশিয়ার দুই সামরিক পরাশক্তি কয়েক দশক ধরে সীমান্ত বিরোধে জড়িয়ে আছে। ভারত এবং চীনের মধ্যে প্রায় ৩ হাজার ৫০০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত এলাকা রয়েছে। এ সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে দুই দেশ প্রায়ই উত্তেজনা সৃষ্টি করে থাকে। ভারতের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, অবহেলিত সীমান্ত অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য তারা এসব অবকাঠামো নির্মাণ করছে। তারা প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখার পাশেই ২০২২ সাল নাগাদ ৬৬টি নতুন সড়ক নির্মাণের ঘোষণা দেয়। এরই মধ্যে গত অক্টোবরে গালওয়ান উপত্যাকার কাছে একটি সড়ক নির্মাণ শেষ করে ভারত। এ সড়কটি দৌলত বেগ অল্ডি ঘাঁটির সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছে। এর ফলে ওই অঞ্চলে চলাচলে সুবিধা পাচ্ছে ভারতীয় সেনাবাহিনী। সড়ক নির্মাণের পরপরই চীন ক্ষিপ্ত হয়। চীন সীমান্ত এলাকায় সেনা বাড়িয়ে বিতর্কিত অঞ্চলে অবকাঠামো নির্মাণ শুরু করে। এতে দুই শক্তিধর রাষ্ট্রের ওই সীমান্তে উত্তেজনা বাড়ে।
চীনের বিরোধিতা কেন?
চীনের লক্ষ্য তার বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের সাধনার ধন কারাকোরাম পাসকে নিরাপদ রাখা। যেটুকু জানা যায়, অনেক দিন ধরে ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পনা করে লাদাখে এগিয়েছে বেইজিং। তারা পুরো শীতকালজুড়ে প্রস্তুতি নিয়েছে এবং ঠাণ্ডা কমার পরই তারা আক্রমণাত্মক ভূমিকা নিতে শুরু করে। এর পিছনে প্রত্যক্ষ কারণ দুটি। এক, লাদাখের গালওয়ান উপত্যকা সংলগ্ন প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখাকে নিজেদের সুবিধাজনক অবস্থানে নিয়ে যাওয়া। অর্থাৎ, ওই ভূখণ্ডের একটি অংশে নিজেদের আধিপত্য স্থাপন করা। দুই, লেহ থেকে কারাকোরাম পাস পর্যন্ত দীর্ঘ রাস্তা এবং পরিকাঠামো তৈরির কাজ বন্ধ রাখতে ভারতের উপর চাপ তৈরি করা। বেজিং-এর ঘাড়ের কাছে ভারত যাতে নিঃশ্বাস ফেলতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে চাওয়া। লাদাখের লেহ থেকে দারবুক, শাইয়োক হয়ে দৌলত বেগ ওলডি বায়ুসেনা ঘাঁটি পর্যন্ত ভারতের অল ওয়েদার রোড তৈরির কাজ প্রায় শেষ। গালওয়ান ভ্যালি হয়ে এই রাস্তা কারাকোরাম পাসের সিয়াচেন পর্যন্ত গেছে। এই রাস্তা নিয়েই আপত্তি চিনের।
কারাকোরাম পাস হলো এমন একটি দুর্গম এলাকা যেখানে খুব কাছাকাছি চীনা ফৌজ, পাকিস্তানি আর্মি এবং ভারতীয় সেনা টহল দেয়। একবার ভারি যানবাহন চলাচল শুরু করলে পুরো এলাকার কৌশলগত সুবিধা চলে যাবে ভারতের হাতে। চাপে পড়বে চীন ও পাকিস্তান। এই সুযোগ ভারত যাতে নিতে না পারে, সেই জন্যই প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা বা এলএসি বরাবর রাস্তা তৈরির বিরোধিতা করছে চীন। সাম্প্রতিক সময় নেপালের বদলে যাওয়া ভূমিকার নেপথ্যেও চীনের প্রভাব দেখতে পাচ্ছেন ভারতের অনেকেই। চীন-নেপালের সাম্প্রতিক সখ্য নিয়ে আপাতদৃষ্টিতে ভারতের কিছু বলার না থাকলেও, নেপাল-ভারত সম্পর্কে সেই সখ্য যে ইতোমধ্যেই প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে তা স্পষ্ট।

Please follow and like us:

Check Also

সাতক্ষীরা সদরের আগরদাঁড়ীতে সড়ক দূর্ঘটনায় পিতা-পুত্র নিহত

স্টাফ রিপোর্টার: সদর উপজেলার আগরদাড়ী মাদ্রাসা সংলগ্ন এলাকায় কাঠবোঝাই ট্রলির তলায় পড়ে পিতা-পুত্র নিহত হয়েছে। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।