চাইলে লাইভ দেখানোর ব্যবস্থা করব, খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের আদালত

ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোট:

জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট ও জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আত্মপক্ষ সমর্থনে ১২ জানুয়ারি পরবর্তী দিন ধার্য করেছেন আদালত।

একই সঙ্গে অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা নূর আহমেদকে জেরা করতে খালেদা জিয়ার করা আবেদন মঞ্জুর করা হয়েছে। তবে এর আগে দুই মামলায় শুনানি নিয়ে উভয় পক্ষের আইনজীবী এবং বিচারকের মধ্যে দীর্ঘ উত্তপ্ত কথোপকোথন হয়েছে।

বেলা ১১টা ২৫ মিনিটে আদালতে হাজির হন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। শুনানির শুরুতে  তাঁর আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া  আদলতকে বলেন, ‘ম্যাডাম খালেদা জিয়া বসার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করছি।’ এ সময় আদালত বলেন, ‘আগে আমাকে বসতে দেন।  এত দেরি করলেন কেন?’

জবাবে  সানাউল্ল্যাহ মিয়া আদালতকে বলেন, ‘দুই দলের রাজনৈতিক কর্মসূচি থাকায় রাস্তায় জ্যাম  রয়েছে। তাই দেরি হয়েছে।’ পরে আদালত  বলেন, ‘ঠিক আছে বসেন।’  এর পর খালেদা জিয়া এজলাসের সামনে দেওয়া একটি  চেয়ারে বসেন।

এ সময় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল আদালতকে বলেন, ‘মাননীয় আদালত  আজ দুটি মামলার আত্মপক্ষ সমর্থনের ওপর আসামিদের  বক্তব্য দেওয়ার কথা রয়েছে।  আমি আশা করি,  আজ চ্যারিট্যাবল এবং অরফানেজ মামলার আসামিদের বক্তব্য শেষ করবেন।’ এ পর্যায়ে খালেদা জিয়ার আইনজীবী ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার বলেন, ‘মাননীয় আদালত  আত্মপক্ষ সমর্থনের বিষয়ে শুনানির জন্য হাইকোর্টে আমাদের আবেদন বিচারধীন রয়েছে। তাই শুনানির জন্য সময় প্রার্থনা করছি।’ এ সময় আদালত  বলেন, ‘আমি ১৯৮১ সালে বিচারক হিসেবে কাজ শুরু করি, তার আগে চার বছর আইনজীবী হিসেবে কাজ করেছি। কিন্তু  আপনারা বিজ্ঞ আইনজীবী আছেন, এখানে একটি বিষয়ে আমাকে পরিষ্কার করেন, ফৌজদারিতে সাক্ষীর শপথ বিষয়ে কী বলা হয়েছে?’ এ সময় আদালত ১৮৭৩ সালের একটি  আইন দেখিয়ে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা জানতে চান।  আদালত বলেন, ‘আপনারা প্রথিতযশা আইনজীবী আপনারা বলেন, শপথ মানে সৃষ্টি কর্তার নামে নয় কি?’

জমির উদ্দিন সরকার  বলেন, ‘অ্যাক্ট অনুযায়ী সৃষ্টি কর্তার নামে, তবে  ২০০৯ সালে সুপ্রিম কোর্টের একটি নির্দেশনা অনুযায়ী এ মামলার সাক্ষীরা তাদের শপথ  গ্রহণ করেনি।’ তিনি বলেন, ‘তাই আমরা উচ্চ আদালতে মামলাটির নিষ্পত্তি পর্যন্ত সময় আবেদন করছি।’

খালেদা জিয়ার অপর আইনজীবী আবদুর রেজাক খান ও মাহবুব উদ্দিন খোকন সময় আবেদন মঞ্জুর করার জন্য আবেদন করেন।

এ সময় দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল আদালতকে বলেন, ‘এ মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থনে খালেদা জিয়াকে আদালত তিনটি প্রশ্ন করেছিলেন। তিনি প্রায় তিনটি প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। প্রথম প্রশ্ন ছিল আপনার (খালেদা জিয়া) বিরুদ্ধে ৩২ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছে। এগুলো সত্য কি না? তিনি বলেছেন, আমি নির্দোষ। দ্বিতীয়ত, আপনি সাফাই সাক্ষী দেবেন কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, হ্যাঁ দেব। এতেই আত্মপক্ষ সম্পূর্ণ হয়ে গেছে। কিন্তু এরপরও আদালত বলেছেন, আর কিছু বলবেন কি না? জবাবে খালেদা জিয়া বক্তব্য দেওয়া শুরু করলেন এবং মাঝপথে গিয়ে বললেন আমি আত্মপক্ষ সমর্থন নিয়ে সময় চাই। এটি হতে পারে না। আমার বক্তব্য হলো আজই আত্মপক্ষের বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে হবে।’

এ বক্তব্যের জবাবে খালেদা জিয়ার আইনজীবী আবদুর রেজাক খান বলেন, ‘উচ্চ আদালতে বিচারাধীন বিষয়ে শুনানির সুযোগ নেই। আমরা এক সপ্তাহ সময় চাই। আশা করি, উচ্চ আদালতে এ বিষয় এক সপ্তাহের মধ্যে নিষ্পত্তি হয়ে যাবে।  আমরা অন্য মামলার শুনানিও করতে চাই।’ আদালত বলেন, ‘শুনানি শুধু  শুনব না, দেখাতেও চাই। আপনারা বার বার এ মামলা আসবেন আর টিভিতে  নিজেদের প্রদর্শন করবেন। আপনারা প্রয়োজন মনে করলে এ মামলার কার্যক্রম লাইভ দেখানোর ব্যবস্থা করব।’

জবাবে আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার বলেন, ‘তাহলে তো আরো  ভালো হয়। আমরা আবেদন করব আপনি যাতে সে ব্যবস্থা করতে পারেন।’ আদালত বলেন, ‘পৃথিবীর অন্য কোথাও এমন বিচার হচ্ছে না।’  জবাবে মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, ‘পৃথিবীর অনেক দেশে এখন সরাসরি বিচারের কার্যক্রম লাইভ দেখানো হয়। এ বিচার লাইভ দেখানো উচিত। তাহলে দেশবাসী ও বিশ্ববাসী জানবে মিথ্যা মামলার বিচার কীভাবে হচ্ছে।’

এ পর্যায়ে আইনজীবী জমির উদ্দিন সরকার বলেন, ‘মাননীয় আদালত আমরা এ মামলার বিচারের জন্য সময় চাচ্ছি।’

এ পর্যায়ে আদালত বলেন, ‘আপনারা সাফাই সাক্ষীর জন্য ২৭১ জনের নাম দিয়েছেন। আসামি কি তাঁর পক্ষের সাফাই সাক্ষীদের সবার নাম বলতে পারেন?’ এ সময় আদালতে কিছুটা হৈচৈ শুরু হয়। পরে আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া  বলেন, ‘আমরা নাম দিয়েছি। তবে এখান থেকে কিছুটা নাম কমে এলে পরে ঠিক করে দেব।’

এ পর্যায়ে আদালত বলেন, ২০১৪ সাল থেকে এ মামলা শুনানি করছি। এখন পর্যন্ত শেষ করতে পারি নাই।  মামলা  কার্যক্রম ডিলে করাটা কতটুকু যৌক্তিক?

এ পর্যায়ে আইনজীবী জমির উদ্দিন সরকার  আবার সময় আবেদন করলে আাদালত বলেন, আমাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু আমি প্রভাবিত নই। আমি জানি আমার জীবনের শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছেছি। এ মামলার রায় কী হবে জানি না। তবে আমি সৃষ্টিকর্তাকে বিশ্বাস করি। আমি বিশ্বাস করি তিনি আমাকে রক্ষা করবেন। পরে আদালত ১২ জানুয়ারি পরবর্তী শুনানির জন্য দিন ধার্য করেন। একই সঙ্গে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত আদালতের কার্যক্রম মুলতবি করেন।

বিরতির সময় খালেদা জিয়া আদালতে বসে ছিলেন। দুপুর আড়াইটার সময় আদালত এজলাসে উঠলে আইনজীবীরা হৈচৈ শুরু করেন। এ সময় একজন আইনজীবী ডেইসের ওপর তিনবার জোরে জোরে থাপ্পর মারেন। এতে করে দুই পক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। সিনিয়র আইনজীবীরা সবাইকে শান্ত করেন।

পরে ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, ‘মাননীয় আদালত, আপনি দুপুরের খাবার খেয়েছেন। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়াকে  দুপুরে খাওয়ার জন্য, নামাজ পড়ার জন্য, এবং এমনকি ওষুধ খাওয়ার জন্য সুযোগ দেওয়া হয়নি। এগুলো কিসের আলামত। আপনি বিচারক আছেন, ভবিষ্যতে বিচারপতি হবেন। এটা আপনার কাছ থেকে আমরা আশা করিনি। জিয়া অরফ্যানেজ ট্রাস্ট মামলার কার্যক্রম ও মুলতবি করা হোক। আজ ৫ জানুয়ারি গণতন্ত্র হত্যা দিবস। এ দিবসে আদালত দুদকের আইনজীবীর আচরণ দেখে মনে হয় ম্যাডাম খালেদা জিয়াকে বিচার শেষ হওয়ার আগে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে।’

এ সময় আদালত বলেন, ‘যে আইনজীবী ডেইসে থাপ্পর মেরেছেন তার নাম জানতে চাই। তাকে ক্ষমা চাইতে হবে। অন্যথায় তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পরে ওই আইনজীবী আদালতে ক্ষমা প্রার্থনা করেন।’ এ পর্যায়ে আদালত বিকেল ৩টার দিকে জিয়া অরফ্যানেজ ট্রাস্ট মামলার কার্যক্রমও ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত মুলতবি ঘোষণা করেন।

জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার পক্ষে ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, আবদুর রেজাক খান, জয়নুল আবদিন, মাহবুব উদ্দিন খোকন ও এ জে মোহাম্মদ আলী শুনানিতে অংশ নেন।

অন্যদিকে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পক্ষে মোশারফ হোসেন কাজল শুনানি করেন। আদেশের সময় আদালতে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু উপস্থিত ছিলেন।

জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, ২০০৫ সালে কাকরাইলে সুরাইয়া খানমের কাছ থেকে ‘শহীদ জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট’-এর নামে ৪২ কাঠা জমি কেনা হয়। কিন্তু জমির দামের চেয়ে অতিরিক্ত এক কোটি ২৪ লাখ ৯৩ হাজার টাকা জমির মালিককে দেওয়া হয়েছে বলে কাগজপত্রে দেখানো হয়, যার কোনো বৈধ উৎস ট্রাস্ট দেখাতে পারেনি। জমির মালিককে দেওয়া ওই অর্থ ছাড়াও ট্রাস্টের নামে মোট তিন কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা অবৈধ লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে।

২০১০ সালের ৮ আগস্ট জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে অবৈধভাবে অর্থ লেনদেনের অভিযোগ এনে খালেদা জিয়াসহ চারজনের নামে তেজগাঁও থানায় দুর্নীতির অভিযোগে এ মামলা করেছিলেন দুদকের সহকারী পরিচালক হারুন-অর রশিদ।

ওই মামলার অন্য আসামিরা হলেন- খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, হারিছের তখনকার সহকারী একান্ত সচিব ও বিআইডব্লিউটিএর নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক জিয়াউল ইসলাম মুন্না এবং অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার একান্ত সচিব মনিরুল ইসলাম খান।

অন্যদিকে, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের দুই কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৪৩ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ এনে খালেদা জিয়া, বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় আরো একটি মামলা করে দুদক।

মামলায় খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান ছাড়া অন্য আসামিরা হলেন- মাগুরার সাবেক সংসদ সদস্য কাজী সালিমুল হক কামাল, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ, সাবেক মুখ্য সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমান

Please follow and like us:

Check Also

ছাত্রনেতা হিরুকে তুলে নেওয়ার অভিযোগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) শাখার ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি মাহিদুল হাসান হিরুকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক তুলে নেওয়ার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।