বাংলাদেশে ধীরগতির পরীক্ষায় সর্বনাশ, নমুনা সংগ্রহে গলদ: ল্যাবে গতিসঞ্চার নেই:মহামারির আশঙ্কা

ক্রাইমর্বাতাবাতা রিপোট: বর্তমানে সক্ষমতা আছে সাড়ে ৫ হাজার, টেস্ট হচ্ছে হাজারের কম * নমুনা সংগ্রহকারীদের যথেষ্ট প্রশিক্ষণ হয়নি * পর্যাপ্ত পরীক্ষা ছাড়া করোনার ভয়াবহতা নিরূপণ সম্ভব নয় * সারা দেশে বুথ করে নমুনা সংগ্রহ করা হবে -মহাপরিচালক

দেশে করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষায় এখনও গতি আসেনি। নমুনা সংগ্রহে গলদ, ল্যাবগুলোর সক্ষমতা কাজে না লাগানোয় কাজটিতে গতিসঞ্চার হচ্ছে না।

অধিকমাত্রায় পরীক্ষা না হওয়ায় করোনার ভয়াবহতা নিরূপণ করা যাচ্ছে না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, দেশে সামাজিকভাবে ভাইরাসটির সংক্রমণ শুরু হয়েছে। আক্রান্তদের বেশির ভাগই জানেন না, তিনি সংক্রমিত হয়েছেন এবং অন্যকে সংক্রমিত করছেন।

যারা ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হয়েছেন কিন্তু লক্ষণ বা উপসর্গ তেমন প্রকাশ পায়নি তাদের দ্রুত শনাক্ত করতে হবে। অন্যথায় ভাইরাসটির ভয়াবহতা থেকে দেশকে রক্ষা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে।

দেশে নভেল করোনাভাইরাসের মহামারী চলছে। রাজধানীসহ দেশে বিভিন্ন স্থানে গুচ্ছ আকারে এর সংক্রমণ শুরু হয়েছে। সংক্রমিত এলাকা লকডাউন করছে প্রশাসন। কিন্তু ওই এলাকার সবাইকে পরীক্ষার আওতায় আনা হয়নি।

এমনকি অধিক পরীক্ষার জন্য ল্যাবের সংখ্যা বাড়লেও সক্ষমতা অনুসারে পরীক্ষা বাড়েনি। প্রতিদিন প্রায় সাড়ে ৫ হাজার নমুনা পরীক্ষার সক্ষমতা থাকলে গড়ে নয়শ’ থেকে এক হাজারের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। এখনও ব্যক্তিগতভাবে অনেককেই পরীক্ষা করানোর জন্য দ্বারে দ্বারে ধরনা দিচ্ছেন।

তাদের অনেকের নমুনা নেয়া হলেও পরীক্ষার ফল জানানো হচ্ছে না। তৃণমূল থেকে যাদের মাধ্যমে নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে তারা যথেষ্ট প্রশিক্ষিত নন। ফলে সঠিক প্রক্রিয়ায় নমুনা সংগ্রহ হচ্ছে না। অনেক নমুনা বাতিল হচ্ছে। এমন মন্তব্য জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বাস্থ্য অধিদফতরের একাধিক কর্মকর্তা  বলেন, পরীক্ষা আশানুরূপ না হওয়ার একটি প্রধান কারণ হল সরকারি নির্দেশনার অভাব। এর আগে পরীক্ষা বাড়ানোর জন্য অধিদফতর প্রতি উপজেলা থেকে কমপক্ষে দুটি করে নমুনা সংগ্রহের নির্দেশ দেয়। তারপর থেকে দিনে গড়ে প্রায় হাজারখানেক পরীক্ষা হলেও নমুনার পরিমাণ বাড়ছে না।

ল্যাব বাড়লেও অধিকাংশই দুটির বেশি নমুনা সংগ্রহ করছেন না। ফলে পরীক্ষা বাড়ছে না। দ্বিতীয়ত, যাদের মাধ্যমে নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে তাদের সঠিকভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়নি। ফলে তারা ঠিকমতো নমুনা সংগ্রহ করতে পারছে না।

একজন ব্যক্তির দুটি নমুনা সংগ্রহ করতে বলা হলেও অনেক ক্ষেত্রে তারা একটি নমুনা সংগ্রহ করছে। নমুনা পরিবহনের জন্য ভিটিএম (ভাইরাস ট্রান্সপোর্ট মিডিয়াম) পদ্ধতি ব্যবহার হচ্ছে না।

এছাড়া পিসিআর (পলিমারি চেইন রি-অ্যাকশন) ব্যবহার করে রোগ নির্ণয় একটি জটিল পদ্ধতি। এজন্য দক্ষ ও প্রশিক্ষিত বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন। কিন্তু কয়েকটি ল্যাবে দক্ষ বিশেষজ্ঞের ঘাটতি রয়েছে। এসব কারণে সক্ষমতা অনুসারে পরীক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না।

জার্নাল অব অ্যামেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (জেএএমএ) তথ্য অনুযায়ী সবচেয়ে ভালো ফল পাওয়া যায় ‘ব্রাঙ্কোলেভোলার ল্যাভেজ’-এ (ফুসফুসের ভেতর থেকে টিউবের মাধ্যমে নমুনা সংগ্রহ করা)। এক্ষেত্রে ৯৩ শতাংশ পজিটিভ ফল পাওয়া সম্ভব। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ‘স্পুটাম’ বা কফ।

এক্ষেত্রে ৭২ শতাংশ পজিটিভ ফল পাওয়া সম্ভব। এরপর যথাক্রমে ‘নাজাল সোয়াবাস’ বা নাকের শ্লেষ্মার নমুনায় ৬৩ শতাংশ, ‘ফাইব্রোঙ্কোস্কোপি ব্রাশ বায়োপসি’ বা শ্বাসনালির নিম্নানাংশের নমুনায় ৪৬ শতাংশ, গলার ভেতর থেকে নমুনা নিলে ৩২ শতাংশ, মলের নমুনায় ২৯ শতাংশ, রক্তের নমুনায় ১ শতাংশ পজিটিভ ফল পাওয়া সম্ভব। তবে মূত্রের নমুনায় করোনাভাইরাস চিহ্নিত করা যায় না।

স্বাস্থ্য অধিদফতর ও মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের তথ্য মতে, বাংলাদেশে নভেল করোনাভাইরাস শনাক্তে সন্দেহজনকদের ‘নাজাল সোয়াবাস’ বা নাকের শ্লেষ্মার নমুনা সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে নমুনায় ভাইরাস চিহ্নিত হওয়ার সুযোগ ৬৩ শতাংশ। তবে সেই নমুনা যদি সঠিকভাবে সংগ্রহ ও পরীক্ষার পূর্বপর্যন্ত সংরক্ষণ করা না হয়, তাহলে সেক্ষেত্রে ভাইরাস চিহ্নিত করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে।

ইতিপূর্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, করোনাভাইরাসে সন্দেহভাজনদের পরীক্ষার আওতায় আনতে হবে। ফেব্র“য়ারি মাস থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একাধিকবার অধিকতর পরীক্ষার ওপর জোর দিয়েছে।

সামগ্রিক বিষয়ে গুরুত্বারোপ করে সরকারের পক্ষ থেকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ২৯টি ল্যব স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। ইতোমধ্যে ১৭টি ল্যাবে নমুনা পরীক্ষা শুরু হয়েছে। কিন্তু তারপরও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না। সন্দেহজনক অনেকেই থেকে যাচ্ছে পরীক্ষার বাইরে।

এ প্রসঙ্গে ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিনের পরিচালক অধ্যাপক ডা. একেএম শামছুজ্জামান বলেন, দেশে বর্তমানে ১৭টি ল্যাবে করোনা পরীক্ষা চলছে। এসব ল্যাবে প্রায় ৩০টি মেশিনে পরীক্ষা হয়।

অর্থাৎ দৈনিক প্রতিটি মেশিন একবার ব্যবহার হলে প্রায় ২৮০০ নমুনা পরীক্ষা করা সম্ভব। আর যদি দিনে দু’বার মেশিনগুলো ব্যবহার হয় তাহলে প্রায় ৫৪০০টি নমুনা পরীক্ষা করা যাবে। তিনি বলেন, নমুনা সংগ্রহের জন্য পর্যাপ্ত মেডিকেল টেকনোলজিস্ট প্রয়োজন।

এক্ষেত্রে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে বা স্বল্প সম্মানীর মাধ্যমে বেসরকারি খাতে কর্মরত বিপুলসংখ্যক টেকনোলজিস্ট সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যে ইতোমধ্যে এ ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য অধিদফতরের দু’জন ডিপিএম (ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার) বলেন, তাদের করোনা প্রাদুর্ভাবের সময় বিদেশ ভ্রমণের ইতিহাস রয়েছে। একজনের পরিবারের সদস্য ভ্রমণ শেষে বিদেশে কর্মস্থলে যোগ দিলে সেখানে তার শরীরের কোভিড-১৯ এর লক্ষণ প্রকাশ পায় এবং তাকে আইসোলেটেড করা হয়।

এরপর এই ডিপিএম তার পরিবারের সদস্যদের পরীক্ষা করাতে আইইডিসিআরে যোগাযোগ করেন। কিন্তু এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায় না। এরপর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার নির্দেশে তার নমুনা সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু তিন সপ্তাহ অতিক্রান্ত হলেও কোনো ফলাফল তাকে জানানো হয়নি।

এতে তিনি যে দফতরে কর্মরত সেই দফতরের সহকর্মীরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। অপর ডিপিএম অনেক চেষ্টা করেও পরীক্ষা করাতে ব্যর্থ হন।

তারা যুগান্তরকে বলেন, আমরা চিকিৎসক এবং অধিদফতরে গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত। তারপরও করোনা পরীক্ষা করাতে পারছি না। এ থেকেই বোঝা যায়, সাধারণ মানুষ কতটা ভোগান্তিতে রয়েছে। করোনা আক্রান্ত এক সাংবাদিকের পরিবারের সদস্যরা সারা দিন বসে থেকেও পরীক্ষা করাতে পারেনি।

গত কয়েকদিনের নমুনা পরীক্ষা পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ৮ এপ্রিল দেশে মোট ৯৮১টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়, সেখানে ৫৪ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়। ৯ এপ্রিল ৯০৫টি নমুনা সংগ্রহ করে ১১২ জন শনাক্ত হয়। ১০ এপ্রিল ১১৮৪টি নমুনা পরীক্ষা করে ৯৪ জন শনাক্ত করা হয়।

এবং ১১ এপ্রিল ৯৫৪টি নমুনা পরীক্ষা করে ৫৮ জন শনাক্ত হয়। এ পর্যন্ত ৮৩১৩ জনকে পরীক্ষা করে মাত্র ৪৮২ জনকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। যা বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সঠিকভাবে নমুনা সংগ্রহ ও সংরক্ষণ না করায় এ ধরনের ফল পাওয়া যাচ্ছে।

দেশে এই সংকটকালে প্রায় ১৫ হাজার বেকার মেডিকেল টেকনোলজিস্ট কাজে লাগানোর দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ মেডিকেল টেকনোলজিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক মহাসচিব সেলিম মোল্লা।

তিনি বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করে প্রায় ১৫ হাজার মেডিকেল টেকনোলজিস্ট বেকার রয়েছে। এই সময় এদের কাজে লাগানো হলে তারা করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারবে।

সামগ্রিক বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, নমুনা পরীক্ষায় আমরা দুই ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছি। একটি হল বিশেষায়িত হাসপাতাল, সেখানে সন্দেহজনক রোগী গেলে তাদের পরীক্ষার আওতায় আনা হবে। অন্যটি হল বাড়ি থেকে নমুনা সংগ্রহ করা। তবে বাড়ি থেকে নমুনা সংগ্রহে অনেক সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।

এক্ষেত্রে আমরা নমুনা সংগ্রহ ‘বুথ’ করার প্রক্রিয়া শুরু করেছি। প্রতিটি এলাকায় এ ধরনের বুথ হবে। লোকজন সেখানে গিয়ে নমুনা দিয়ে আসবেন। এক্ষেত্রে কমিউনিটি ক্লিনিক হেলথ কেয়ার প্রভাইডারদের কাজে লাগানো হবে।

এছাড়া প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের আওতাধীন সব প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবগুলো করোনা পরীক্ষার আওতায় আনা হবে। এতে করে প্রতিদিন বিপুলসংখ্যক পরীক্ষা করা সম্ভব হবে।যুগান্তর

Please follow and like us:

Check Also

ভোটার নেই, কেন্দ্রে আনসার সদস্যদের রান্নার আয়োজন

ভোটার উপস্থিতি একেবারেই কম। অনেক সময় বিরতি দিয়ে দুই একজন কেন্দ্রে প্রবেশ করেন। এমন পরিস্থিতিতে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।