অধ্যাপক মাযহারুল ইসলাম : নবী করীম সা. বলেছেন, ‘লি কুল্লী কওমী ইদান ওয়া হাযা ইদুনা’ অর্থাৎ প্রত্যেক জাতির তার নিজস্ব উৎসব রয়েছে। আর এটা হচ্ছে আমাদের উৎসব।” Ñবুখারী, মুসলিম। মুসলমানদের জন্য দুটি জাতীয় উৎসব আছে। সমগ্র মুসলিম বিশ্বে একই নিয়মে এবং রীতিতে নারী-পুরুষ, আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা মহা আনন্দের সাথে এ উৎসব দুটি পালন করে থাকে এবং দুনিয়ার শেষ দিনটি পর্যন্ত পালন করে যাবে। তার একটি হলো ঈদুল ফিতর এবং আরেকটি হলো ঈদুল আজহা। দুই মাস আগে এক মাস পবিত্র সিয়াম পালনের পর আমরা ঈদুল ফিতর উদযাপন করেছি। আগামীকাল আমরা ঈদুল আজহা পালন করবো, ইনশাআল্লাহ। তবে কালের পরিক্রমায় ২০২০ সালের এই আনন্দের উৎসব দুটিই বিশ্বজুড়ে এক অদৃশ্য প্রাণঘাতী ক্ষুদ্র করোনা ভাইরাস কোভিড-১৯ মানবজাতিকে স্তম্ভিত, দিশেহারা, স্তব্ধ এবং স্থবির ও তছনছ করে এবং থমকে দিয়েছে। একইভাবে মুসলিম বিশ্বের এই আনন্দ-উৎসব দুটিও ম্লান এবং মলিন হয়ে গেছে। এমনকি মুসলিম বিশ্বের লাখ লাখ মুসলিমদের “লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক” ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে আল্লাহর মেহমান হিসেবে আরাফাত ময়দানে হাজির হয়ে পবিত্র হজ পালন এবং মীনায় কুরবানি করাও সাময়িক বন্ধ করে দিয়েছে। করোনা মহামারিতে সারা বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রসহ প্রায় সব রাষ্ট্র অস্থির হয়ে উঠেছে এর থেকে মুক্তি লাভের জন্য এবং বড় বড় বিজ্ঞানীগণ চিন্তা ও গবেষণায় মগ্ন ও ব্যস্ত রয়েছেন এর প্রতিষেধক আবিষ্কারের জন্য। কিন্তু এখনো ধরা ছোঁয়ার বাইরেই রয়েছে প্রতিষেধক। সারা বিশ্বজাহানের মালিক মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তায়ালা যে মহাক্ষমতাধর, এই ক্ষুদ্র করোনা ভাইরাস তারই ইঙ্গিত বহন করে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, অত্যন্ত দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় এই যে, প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসজনিত এই মহামারির মহাসঙ্কটকালেও তার ওপর আবার বন্যাকবলিত দুর্যোগেও মানুষের মধ্যে কোনো নিয়মনীতি নৈতিকতা ও মানবিকতার চেতনা নেই। ঘুষ, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, অমানবিকতা, অন্যায়, অবিচার, খুন-খারাবিসহ নানাবিধ অনাচার, অনাসৃষ্টি যেন চলছেই। এহেন অবস্থায় সততা ও মানবতাবোধ এবং নীতিনৈতিকতাসহ ভালোভাবে চলার অঙ্গীকার ও শপথ নিয়ে খালেছভাবে তাওবা করে আমরা কায়মনোবাক্যে আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করবোÑ ‘হে আল্লাহ! করোনা ভাইরাসসহ যাবতীয় বালা-মুসিবত থেকে আমাদেরকে তথা বিশ্বমানবতাকে হেফাজত করুন এবং এই প্রাণঘাতী ভাইরাস থেকে মুক্তি লাভের জন্য বিজ্ঞানীদের প্রতিষেধক আবিষ্কারের তাওফিক দান করুন। এই অদৃশ্য প্রাণঘাতী ভাইরাসকে দূরীভূত, ধ্বংস করে দিন।’ আমিন।
এবার আসি ঈদুল আজহার কথায়। বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর ত্যাগ ও উৎসর্গের নিদর্শনস্বরূপ জিলহজ মাসের ১০ তারিখ পশু কুরবানির মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বে যে আনন্দ-উৎসব পালিত হয়, তাই হলো ঈদুল আজহা বা পশু কুরবানির আনন্দ-উৎসব। ত্যাগের মহীমায় উদ্দীপ্ত হয়ে মুসলিম বিশ্বের প্রতিটি মুসলিম এবং অমুসলিম বিশ্বেরও মুসলিম নাগরিকগণ জিলহজ মাস এলেই ঈদুল আজহার দিনটির জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে এবং ১০ জিলহজ সকালে দুই রাকাত ঈদুল আজহার ওয়াজিব নামাজ পড়ে এসে পশু কুরবানি করে এবং শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে নারী-পুরুষ, আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা নির্মল আনন্দ-উৎসবে মুখরিত হয়ে ওঠে।
মুসলমানদের এই কুরবানির বিষয়টি হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসছে। সাড়ে চার হাজার বছর আগে হজরত ইবরাহীম আ. তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় একমাত্র পুত্র ১৩ বছরের কিশোর ইসমাঈল আ.-কে নিয়ে কুরবানির যে ইতিহাস, তা সত্যিই মর্মন্তুদ, হৃদয়স্পর্শী এবং এক কঠিন পরীক্ষার চরম ও করুণ ইতিহাস।
হজরত ইবরাহীম আ. আল্লাহ কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুসন্তানসহ বিবি হাজেরাকে নিজ বাসস্থান ফিলিস্তিন থেকে সহস্রাধিক কিলোমিটার দূরে মক্কার নির্জন পাহাড়ের পাদদেশে সামান্য খাদ্য ও পানীয়সহ রেখে আসেন। ধীরে ধীরে সেই সন্তান কিশোর বয়সে উপনীত হয়। হজরত ইবরাহীম আ. এক রাতে স্বপ্ন দেখেন যে, তিনি তাঁর প্রিয়তম বস্তুকে কুরবানি দিচ্ছেন। তখনই তিনি চিন্তা করলেন যে, তাঁর জীবনের সবচাইতে আদরের ধন, চোখের মণি, কলিজার টুকরা একমাত্র সন্তান তাঁর সবচাইতে প্রিয় ধন ইসমাঈল আ.। তাই তিনি তাকেই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কুরবানি দেবেন। কালবিলম্ব না করে ছুটে চললেন মক্কা অভিমুখে প্রিয় স্ত্রী বিবি হাজেরা এবং প্রিয় সন্তানের উদ্দেশে।
মক্কার নির্জন পাহাড়ে পাদদেশে বিবি হাজেরার কাছে পৌঁছেই তিনি তার স্বপ্নের কথা জানালেন। কিশোর বালক তাঁর পিতার মুখে এ কথা শোনার সাথে সাথেই রাজি হয়ে বললেন, হে আব্বু! আল্লাহ যা আপনাকে করতে বলেছেন তাই করুন। মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইবরাহীম আ. তারই সৌভাগ্যবান সন্তান ইসমাঈল আ.-কে নিয়ে আল কুরআনে আয়াত নাজিল হয়েছে এবং নবী করিম সা.-এর মুখ দিয়ে অমীয় বাণী ‘হাদীস নিসৃত হয়েছে’ ইতিহাসের সোনালি অক্ষরে লেখা হয়েছে এই ইতিহাস। হজরত ইবরাহীম আ. তার পুত্রকে নিয়ে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে কুরবানি দেয়ার জন্য রওনা করলেন। মা বিবি হাজেরা হাসিমুখে তার বুকের মানিক পুত্রকে তুলে দিলেন পিতার হাতে। মাতা-পিতা ও পুত্রের ঈমানী বল, দৃঢ়তা, বলিষ্ঠতা সর্বোপরি আল্লাহ তায়ালার আদেশের প্রতিপালন তাদেরকে একসূত্রে যেন গেঁথে দিল। এ যেন দ্বিধাহীনচিত্তে আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণভাবে নিজেদেরকে সমর্পণ করার চরমতম একটি মহান নিদর্শন।
পথিমধ্যে মানুষের চিরশত্রু শয়তান হজরত ইবরাহীম আ.-কে তিন জায়গায় বাধা প্রদান ও ভ্রান্ত পথে চলার প্ররোচনা দেয়। কিন্তু অভিশপ্ত শয়তান হয়ে যায় ব্যর্থ। আল্লাহর প্রতি যাদের ঈমান অবিচল, অনড়, অটল তারা কি কখনও বিভ্রান্ত হতে পারে?
হজরত ইবরাহীম আ. তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে পুত্রকে মাটিতে কাত করে শুয়ালেন আল্লাহর রাস্তায় কুরবানির উদ্দেশ্যে। তিনি তাঁর ধারালো ছুরি পুত্রের গলায় চালানোর জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন। যখনই তিনি (পিতা) সন্তানের গলায় ছুরি চালাতে উদ্যত হলেন, তখনই রাহমানুর রাহীম আল্লাহ তায়ালার রহমতের সাগরে জোয়ার এলো। মহান আল্লাহ ছুরির নিচ থেকে অলৌকিকভাবে তার কুদরতে ইসমাঈল আ.-কে সরিয়ে নিয়ে বেহেশত থেকে একটি দুম্বা পাঠিয়ে শুইয়ে দিলেন এবং যথারীতি দুম্বা কুরবানি হয়ে গেল। আল্লাহ তায়ালা ইবরাহীম আ.-কে বললেন, তুমি স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছ এবং সফল হয়েছ। আল কুরআনে মহান আল্লাহ তায়ালা নিম্নোক্তভাবে এ ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন।
“সে (ছেলেটি) যখন তার (পিতার) সাথে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হলো, তখন (একদিন) ছেলেকে ইবরাহীম বললেন, প্রিয় বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে জবাই করছি, এখন তুমি কী বল? সে (ছেলে) বললেন, হে আমার পিতা! আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন তাই করুন। ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন। অতঃপর দু’জনই (পিতা-পুত্র) আল্লাহর ইচ্ছার প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ করলো এবং ইবরাহীম (আ.) তার পুত্রকে কাত করে মাটিতে শুইয়ে দিল, তখন আমি ডাক দিলাম, হে ইবরাহীম তুমি তোমার স্বপ্নকে কার্যত বাস্তবায়ন করেছোÑ এভাবেই আমি সৎকর্মপরায়ণদের পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চয়ই ইহা হচ্ছে এক মহাপরীক্ষা। আর আমি তাকে মুক্ত করলাম এক মহাকুরবানির বিনিময়ে। আমি ইহা পরবর্তীদের স্মরণে রেখেছি।” Ñসূরা সাফফাত : ১০২-১০৮।
উল্লেখ্য, এই কুরবানির ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল মীনা নামক স্থানে। এ ঘটনার স্মৃতিস্বরূপ মুসলিম দুনিয়া ১০ জিলহজকে কুরবানির দিন হিসেবে উদযাপন করে আসছেন। আর এদিন বিশ্বের মুসলমানগণ আল্লাহর নামে কুরবানি করেন লাখকোটি পশু। উল্লেখ্য, হাজীরা যখন হজ করতে যায়, তখন ঈমানী দৃঢ়তায় বলীয়ান সেই মহীয়সী নারী বিবি হাজেরার অনুসরণে আজো সাফা-মারওয়া পাহাড় সাতবার দৌড়াদৌড়ি করে। স্মরণযোগ্য যে, ইবরাহীম আ. বিবি হাজেরা এবং শিশুপুত্রকে মক্কার মরুভূমিতে পাহাড়ের পাদদেশে সামান্য খাদ্য এবং পানীয়সহ রেখে চলে আসেন। পরবর্তীতে বিবি হাজেরা শিশুপুত্রের খাদ্য ও পানির জন্য মরুভূমির উক্ত দুই পাহাড়ে উঠে দৌড়াদৌড়ি করে খাদ্য ও পানির অনুসন্ধান করেন। খাদ্য ও পানি না পেয়ে ফিরে এসে দেখেন, শিশু ইসমাঈলের পায়ের কাছে পানির নহর প্রবাহিত হচ্ছে। সেটাই হচ্ছে জমজম কূপের পানি। হাজীগণ জমজমের পানি পান করে থাকেন এবং নিজ নিজ বাড়িতেও নিয়ে যান। আরাফাত ময়দান থেকে মীনায় ফিরে এসে হজরত ইবরাহীম আ.-কে প্ররোচনাকারী শয়তানকে প্রতীকীভাবে ২/৩ দিন মীনায় অবস্থান করে ঢিল ছুড়েন এবং বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহর পানাহ চান এবং মীনাতে অবস্থানকালীন সময়ে হজরত ইবরাহীম আ.-এর সুন্নত অনুসরণ করে পশু কুরবানি করেন।
ইসলামের ইতিহাসে হজরত ইবরাহীম আ. একটি অবিস্মরণীয় নাম। হজরত নূহ আ.-এর পর হজরত ইবরাহীম আ. হচ্ছেন সর্বপ্রথম ব্যক্তিত্ব, যাকে আল্লাহ বিশ্বব্যাপী ইসলামের মহান দাওয়াত দেয়ার দায়িত্বে নিয়োজিত করেছিলেন। তিনি সর্বপ্রথম ইরাক থেকে মিসর পর্যন্ত এবং পরবর্তীতে সিরিয়া, ফিলিস্তিন ও আরবের বিস্তৃত বিশাল মরু অঞ্চলে বছরের পর বছর ঘুরেফিরে আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আনুগত্য তথা ইসলামের পথে মানবজাতিকে আহ্বান করতে থাকেন। তিনি এ বিস্তীর্ণ ভূখ-ের বিভিন্ন এলাকায় তার প্রতিনিধি নিযুক্ত করেন। জর্ডান নদীর উপকূলে আপন ভ্রাতুষ্পুত্র লুতকে নিযুক্ত করেন। ফিলিস্তিনে নিযুক্ত করেন কনিষ্ঠ পুত্র ইসহাককে এবং আরব অঞ্চলের দায়িত্ব দেন প্রিয় পুত্র ইসমাঈলকে। আর তিনি পুত্র ইসমাঈলকে নিয়ে আরবের মক্কা অঞ্চলে তৈরি করেন আল্লাহর ঘর ‘কা’বাগৃহ’, যা হজরত ইবরাহীম আ.-এর দাওয়াতী মিশনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। অতঃপর আল্লাহর কাছে পিতা-পুত্র মিলে এক সাথে দোয়া করেনÑ ‘স্মরণ করো যখন ইবরাহীম ও ইসমাঈল কা’বাগৃহের প্রাচীর তুলছিল, তখন তারা বলছিল, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের এই কাজ গ্রহণ করো, নিশ্চয়ই তুমি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞাত।’ “হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের উভয়কে তোমার একান্ত অনুগত করো এবং আমাদের বংশধর থেকে তোমার এক অনুগত উম্মত করিও। আমাদেরকে ‘ইবাদতের নিয়ম পদ্ধতি’ দেখিয়ে দাও এবং আমাদের প্রতি ক্ষমাশীল হও। তুমি অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু। হে আমাদের প্রতিপালক! তাদের মধ্য থেকে তাদের নিকট একজন রাসূল প্রেরণ করিওÑ যে তোমার আয়াতসমূহ তাদের নিকট তিলাওয়াত করবে; তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেবে এবং তাদের পবিত্র করবে। তুমি তো ক্ষমাশীল, প্রজ্ঞাময়।” Ñসূরা আল বাকারা : ১২৭-১২৯।
আল্লাহ তায়ালা যাকে মর্যাদাবান ও সম্মানীত করতে চান, তাকে এভাবেই সম্মানীত করে থাকেন। কঠিন কঠিন পরীক্ষা দিয়ে তাদেরকে যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে উত্তীর্ণ করে নেন। আপন সন্তান কুরবানির প্রস্তুতির মাধ্যমে আল্লাহর পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ হলেন, যেভাবে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন অগ্নিকু-ে নিক্ষেপিত হওয়ার মতো কঠোরতম পরীক্ষায়, যেভাবে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন দীর্ঘপথ অতিক্রম করে ইরাক থেকে মিসর গমন, আবার মিসর থেকে ফিলিস্তিন গমনের হুকুম নির্দ্বিধায় পালনের মাধ্যমে। আল্লাহর নির্দেশের মোকাবিলায় তার স্নেহ-মায়া-মমতার মাত্রা যতটুক,ু আল্লাহ তাও পরীক্ষা নিয়েছেন একমাত্র দুগ্ধপায়ী শিশুকে মা হাজেরাসহ নির্জন মরুভূমিতে একাকী রেখে এসে। অতঃপর চূড়ান্ত পরীক্ষাÑ সেই শিশু যখন ১২/১৩ বছরে পৌঁছে, তাকে মায়ের কোল থেকে নিয়ে আল্লাহর ইচ্ছা পূরণের জন্য কুরবানির উদ্দেশে রওনা দেয়াসহ সব পরীক্ষাতেই তিনি উত্তীর্ণ হয়েছেন সফলভাবে। আল্লাহ তায়ালা তার দোয়া কবুল করেছেন এবং তারই উত্তরসূরি বংশধর থেকে শেষ নবী, বিশ্বমানবতার মুক্তির দিশারী রাহমাতুল্লীল আলামিন হজরত মুহাম্মদ সা.-কে জন্মদান করেছেন।
“হে প্রভু! আমি আমার পরিবারের একাংশকে পবিত্র গৃহের পার্শ্বে এক তরুলতাবিহীন উপত্যকায় এনে বসবাস করিয়েছি। হে প্রভু! তারা যেন সালাত প্রতিষ্ঠা করতে পারে। তাই মানবজাতির একাংশের হৃদয়কে তাদের প্রতি আকৃষ্ট করে দিন, আর তাদেরকে ফলফলাদি দিয়ে রিজিক দান করুন, যেন তারা শোকর আদায় করতে পারে।” Ñসূরা ইবরাহীম : ৩৭।
মহান রাব্বুল আলামিন হজরত ইবরাহীম আ. ও ইসমাঈল আ.-এর ত্যাগের স্মৃতিকে অবিস্মরণীয়, প্রাণবন্ত এবং শিক্ষণীয় করার লক্ষ্যে মুসলমানদের জন্য কুরবানির বিধান পালনীয় করে রেখেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘আমরা প্রত্যেক উম্মতের জন্য কুরবানির নিয়ম নির্দিষ্ট করে দিয়েছি, যেন (সেই উম্মতের) লোকেরা সেই জন্তুর ওপর আল্লাহর নাম নেয়, যা তিনি তাদেরকে দান করেছেন।’ Ñ সূরা হজ : ৩৪। আল্লাহ তায়ালা সূরা কাউসারে ২নং আয়াতে বলেছেন, ‘সুতরাং আপনি আপনার প্রতিপালকের উদ্দেশে সালাত আদায় করুন ও কুরবানি করুন।’ উল্লেখ্য, ৮৬ বছর বয়সে প্রাপ্ত হৃদয়ের টুকরো শিশুপুত্রকে কুরবানি দেয়ার নির্দেশনা মূলত মহান আল্লাহর একটি পরীক্ষা। এ পরীক্ষায় ইবরাহীম আ. উত্তীর্ণ হন এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করতে সক্ষম হন। তাকওয়া ও ঈমানের শক্তিতে কতটুকু দৃঢ়চেতা ও বলীয়ান, তা মুসলিম জাতির সামনে উপস্থাপন করার উদ্দেশ্যে আল্লাহ তায়ালা হজরত ইবরাহীম আ.-এর ওপর এ চরমতম কঠিন পরীক্ষার অবতারণা করেন। এর আগেও তাকে বহু কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়েছিল এবং সকল পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। মানুষ যেন আল্লাহর ভালোবাসা ও সন্তুষ্টি লাভের মাধ্যমে ত্যাগ-তিতিক্ষার মনোভাব ও তাকওয়া অর্জন করতে পারে, এ লক্ষ্য নিয়েই কুরবানির প্রচলন করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহর কাছে কখনোই পৌঁছায় না উহাদের গোশত এবং রক্ত, বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া।’ Ñসূরা হজ : ৩৭। কুরআনের এই আয়াতেও স্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয় যে, কুরবানির মূল উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং ত্যাগের আদর্শ পরিস্ফুটনের এক উত্তম মাধ্যম। মানুষের পশুমনোবৃত্তি, লোভ-লালসা নাফসানিয়াত, সর্বোপরি সমস্ত খারাপ, অন্যায়, অসৎ ও অনৈতিকতা পরিহার ও পরিত্যাগ করে মানবকল্যাণের লক্ষ্যে নৈতিক ও সৎকর্ম সম্পাদন করা এবং সমাজে সহানুভূতিশীল, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির মনোভাব ও পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যই হলো কুরবানি।
হাদীস শরীফে আছেÑ সাহাবায়ে কিরাম ‘মহানবী সা.কে জিজ্ঞেস করলেন, কুরবানি কী? নবী করিম সা. বললেন, এটা তোমাদের পিতা হজরত ইবরাহীম আ.-এর সুন্নত। সাহাবীগণ বললেন, এতে আমাদের কী সাওয়াব আছে। নবী কমির সা. বললেন, কুরবানির পশুর প্রত্যেকটি লোমের বিনিময়ে একটি করে নেকী বা সাওয়াব লাভ হবে।’ (মিরমিযী ও ইবনে মাজাহ)।
হজরত ওমর রা. বলেন, নবী করিম সা. মদীনার দশ বছরের জীবনে প্রতি বছরই পশু কুরবানি করেছেন।
তাই আমাদের যাদের সামর্থ্য আছে, তাদের অবশ্যই কুরবানি করা উচিত। সর্বোপরি কুরবানির যে মহৎ উদ্দেশ্য হজরত ইবরাহীম আ. এবং হজরত ইসমাঈল আ.-এর ত্যাগ ও কুরবানির কথা স্মরণ করে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে এই মহামারি ও দুর্যোগের এক মহাসঙ্কটকালে ত্যাগের মনোভাব নিয়ে মানবতার সেবায় সকলকে এগিয়ে আসার আকুল আবেদন জানাচ্ছি।
পরিশেষে বলতে চাই, বর্তমান মুহূর্তে মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত, দরিদ্র প্রায় সকলেই চরমভাবে দুর্দশাগ্রস্ত। তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি-বাকরি, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা সবই প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। আর্থিক কষ্ট চরম আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে খাবার এবং চিকিৎসা সঙ্কট দেখা দিয়েছে। তাই এই দুঃসময়ে মানবতার পাশে দাঁড়ানো প্রত্যেকটি ব্যক্তির নৈতিক, মানবিক এবং অত্যাবশ্যকীয় কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তাই এ বিষয়ে আমাদের যার যতটুকু আছে, তাই নিয়ে তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসা অপরিহার্য এবং এটাই মানবতা এবং ঈমানের দাবি। আর যারা সচ্ছল-ধনী, তাদের তো এ মুহূর্তে সমাজের মানুষের পাশে সর্বক্ষণ থাকা দরকার এবং অকাতরে গরিবের সেবায় এবং যারা করোনা এবং বন্যার কারণে অর্থাভাবে অনাহারে-অর্ধাহারে আছে, মানবেতর জীবনযাপন করছে, তাদেরকে সাহায্য করা অপরিহার্য কর্তব্য হয়ে পড়েছে। উল্লেখ্য, সর্বদা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং মানব সমাজের কল্যাণে কাজ করা এখন সময়ের একান্ত দাবি।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালার বাণী এবং রাসূলে করীম সা.-এর দুটি হাদীসের উল্লেখ করে এ আলোচনার ইতি টানবো।
“তুমি কি দেখেছো তাকে যে দীনকে অস্বীকার করে? সে তো সে-ই, যে এতিমকে রূঢ়ভাবে তাড়িয়ে দেয় এবং সে অভাবগ্রস্তকে খাদ্যদানে উৎসাহ দেয় না।” Ñসূরা আল মাউন : ১-৩।
নবী করিম সা. বলেছেন, “বিধবা, বৃদ্ধ ও মিসকিনদের সাহায্যের জন্য চেষ্টা-সাধনাকারী আল্লাহর পথে জিহাদকারীর মতো। (রাবী বলেন) আমার ধারণা তিনি (নবী) এ কথাও বলেছেন, অবিরাম নামাজ আদায়কারী এবং অনবরত রোজা রাখা ব্যক্তির মতো।” Ñবুখারী ও মুসলিম।
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘মহান ও পরাক্রমশালী আল্লাহ কিয়ামতের দিন বলবেন, হে বনী আদম! আমি রোগাক্রান্ত ছিলাম, তুমি আমাকে দেখতে যাওনি। বান্দা বলবে, হে আমার প্রতিপালক! আমি কেমন করে আপনার খবর নিতে যেতাম, আপনি যে বিশ্বজাহানের প্রভু? তিনি বলবেন, তুমি কি জানতে না যে, আমার অমুক বান্দা রোগগ্রস্ত ছিল? তুমি তাকে দেখতে যাওনি? তুমি কি জানতে না, তুমি যদি তার খোঁজখবর নিতে যেতে, তাহলে আমাকে তার কাছে পেতে? হে বনী আদম! আমি তোমার কাছে খাবার চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে খাবার দাওনি। বান্দা বলবে, হে আমার প্রতিপালক! আমি কেমন করে আপনাকে খাওয়াতাম, আপনি যে বিশ্বজাহানের মালিক ও প্রতিপালক? আল্লাহ বলবেন, তুমি কি জানতে না, আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে খাবার চেয়েছিল? কিন্তু তুমি তাকে খাওয়াওনি। তুমি কি জানতে না, তুমি যদি তাকে খাবার খাওয়াতে, তাহলে আমার কাছ থেকে তা পেয়ে যেতে? হে বনী আদম! আমি তোমার কাছে পানি চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে পান করাওনি। বান্দা বলবে, হে আমার প্রভু! আমি কেমন করে আপনাকে পান করাতাম। আপনি যে সমগ্র বিশ্বজাহানের মালিক ও প্রভু? আল্লাহ বলবেন, আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে পানি চেয়েছিল, তুমি তাকে পান করাওনি। তুমি কি জানতে না, তুমি যদি তাকে পানি পান করাতে তাহলে (এখন) আমার কাছ থেকে তা পেতে (অর্থাৎ তার সাওয়াব)।’ (মুসলিম শরিফ)।
আসুন, সকলেই ত্যাগ ও কুরবানির শিক্ষা অন্তরে ধারণ করে কার্যত প্রমাণ করি, “ইন্নাসসালাতী, ওয়া নুসুকী ওয়া মাহইয়াইয়া, ওয়া মামাতী লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন। “বল, আমার নামাজ, আমার কুরবানি, আমার জীবন ও আমার মৃত্যু সকিছুই বিশ্বজাহানের প্রতিপালক একমাত্র আল্লাহ তায়ালার জন্য।” (সূরা আন’আম : ১৬২)।
আমাদের ত্যাগ উৎসর্গ ও কুরবানির মহিমায় আসন্ন ঈদুল আজহা উদ্দীপ্ত ও উদ্ভাসিত হয়ে উঠুক ধনী-গরিব সকল শ্রেণির মানুষের মাঝে তারা সারা বিশ্বে। আল্লাহ আমাদের কবুল করুন। আমিন।
